কুমিল্লা প্রতিনিধি
এবারের বন্যায় কুমিল্লার ১৪ উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তিন হাজার ৩৬২ কোটি টাকার বেশি। এরমধ্যে বানের পানির স্রোতে মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে ও বিধ্বস্ত হয়ে ক্ষতি হয়েছে এক হাজার ৮৪ কোটি টাকার বেশি বলে জানিয়েছেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা।
তবে বানভাসি ও ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, সরকারি দপ্তরের হিসাব চেয়ে বাস্তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি হবে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবেদ আলী বলেন, এখন পর্যন্ত প্রতিটি দপ্তর থেকে নেওয়া তথ্যে জেলায় বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তিন হাজার ৩৬২ কোটি ১৪ লাখ ৭৩ হাজার ৬৩৮ টাকা। ১৪ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বুড়িচং উপজেলায়। এ উপজেলায় ক্ষতির পরিমাণ ৫৫৬ কোটি ১৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫৪৩ টাকা। এরপর ক্ষতি হয়েছে নাঙ্গলকোট উপজেলায়। এ উপজেলায় ক্ষতির পরিমাণ ৫২৮ কোটি ৮৯ লাখ ৬ হাজার ৭৭৮ টাকা।
চৌদ্দগ্রামে ৪৬১ কোটি, লাকসামে ৩৯২ কোটি, কুমিল্লা আদর্শ সদরে ৩৩১ কোটি, ব্রাহ্মণপাড়ায় ২৫৮ কোটি, দেবিদ্বারে ২৩৫ কোটি, মনোহরগঞ্জে ১৭৫ কোটি, বরুড়ায় ১২১ কোটি, কুমিল্লা সদর দক্ষিণে ১১৫ কোটি, লালমাইতে ৭১ কোটি, তিতাসে ৫৬ কোটি, মুরাদনগরে ৪৭ কোটি এবং দাউদকান্দিতে নয় কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
জেলায় মোট আট হাজার ৬৭৪টি বাড়িঘর পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে মোহাম্মদ আবেদ আলী বলেন, ভয়াবহ এই বন্যায় এসব বাড়িঘরের বেশিরভাগই বানের স্রোতে ভেসে গেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বুড়িচং উপজেলায়। এ উপজেলায় চার হাজার ১৪৩টি বাড়িঘর পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কুমিল্লা আদর্শ সদর, চৌদ্দগ্রাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলায় এক হাজারের বেশি করে তিন হাজারের বেশি বাড়িঘর পুরোপুরি ক্ষতির মুখে পড়েছে। বাকি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা ৭৪ হাজার ৮১টি। ঘরবাড়ি ভেঙে ও বিধ্বস্ত হয়ে মোট ক্ষতি হয়েছে এক হাজার ৮৪ কোটি ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানানো হয়, বন্যায় কুমিল্লায় মোট ২৩ হাজার ৪২টি মৎস্য খামার (পুকুর, দিঘি, মাছের ঘের) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ২৫ হাজার ৫৩৮ দশমিক ৫০ টন মাছ, ১০ দশমিক ২৮ টন চিংড়ি এবং ১০ কোটি ১৭ লাখ সংখ্যক পোনামাছের ক্ষতি হয়েছে। বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী ৩৫৮ কোটি ১২ লাখ টাকার মাছ, পাঁচ কোটি টাকার বেশি চিংড়ি এবং ১৭ কোটি আট লাখ ৯২ হাজার টাকার পোনা জাতীয় মাছের ক্ষতি হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, বন্যায় রোপা আমনের বীজতলা, রোপা আমন, শাক-সবজি, রোপা আউশ ও আখের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। কুমিল্লা জেলায় আবাদ করা জমির পরিমাণ এক লাখ ৩৫ হাজার ২৩৮ হেক্টর। যার মধ্যে ৬৩ হাজার ৯৭৪ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে কৃষিখাতে। জেলায় কৃষি ও মৎস্য সম্পদের পাশাপাশি প্রাণিসম্পদেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় জানায়, প্রাথমিক তথ্যে এই খাতে মোট ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তবে এই ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বেলাল হোসেন জানান, কুমিল্লায় বন্যায় মৎস্য খাতে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেই হিসাবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মত ক্ষতি হয়েছে। বানের পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সঠিকভাবে বলা যাবে। ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়তে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কুমিল্লার উপ-পরিচালক আইউব মাহমুদ বলেন, এবারের বন্যায় কুমিল্লায় কৃষকরা প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষি প্রণোদনা, বিনামূল্যে সার ও বীজ বিতরণ, ক্ষুদ্র ঋণ নেওয়ায় সহায়তা, বিনামূল্যে কৃষি সেবা ও সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা চন্দন কুমার পোদ্দার বলেন, জেলায় চার হাজারেরও বেশি গবাদিপশুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে দুই লাখ নয় হাজার বিভিন্ন জাতের গবাদিপশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে গরুর সংখ্যা এক লাখ ২০ হাজার, ১৬টি মহিষ, ৩০ হাজার ছাগল, ৭০০ ভেড়া। তার মধ্যে মারা গেছে ৩৫টি গরু, তিনটি মহিষ, ১৭১টি ছাগল এবং সাতটি ভেড়া।
তিনি বলেন, এসবেব বাইরে দুই হাজার ২১৮টি খামারে ১৩ লাখ ৬৬ হাজার হাঁস-মুরগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছে ১০ লাখ ২২ হাজার মুরগি এবং ২ হাজারের বেশি হাঁস। এটি চূড়ান্ত তালিকা নয়। প্রাথমিকভাবে তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেলে সম্পূর্ণ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের সব ধরনের সহযোগিতা করছি।
উল্লেখ্য, গত ১৯ আগস্ট থেকে কুমিল্লা বন্যায় প্লাবিত হতে থাকে। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্যার ভয়াবহতা বাড়তে থাকে। ২২ অগাস্ট রাত পৌনে ১২টায় গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে যায় বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকায়। এতে বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা পুরোপুরি প্লাবিত হয়ে তলিয়ে যায় মানুষের ঘরবাড়ি, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্লাবিত হয় আশপাশের উপজেলাগুলোও।