![](https://amarkagoj.com/wp-content/uploads/2024/06/17136893611-1.jpg)
সৈয়দ মুশফিকুর রহমান
গত অর্থবছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রুপকল্প ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে ২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট বাংলাদেশের রূপকল্প ঘোষণা করেন। অবশ্য ২০০৯ সাল থেকেই এই খাতের বিকাশে নানা রকম সুবিধা দিয়ে আসছে সরকার। বিগত দশকে এই খাতের অভাবনীয় সাফল্য সারাদেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কেউই দ্বিমত করবে না। উন্নয়নের দেড় দশক পেরিয়ে এখন স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
এই বাজেটে কিছু পণ্যে আয়কর, শুল্ক, ভ্যাট অথবা সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তব্যেও সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের কথা বারবারই উল্লেখ করেছেন। ফলে সবাই আগ্রহভরে অপেক্ষা করছিল, বিশেষ করে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবৃত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী আশা করছিলো মূল্যস্ফীতি ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজেটে সুনিদিষ্ট কিছু বিষয় থাকবে। কিন্তু এ বিষয়ে তেমন কিছুরই উল্লেখ নেই। বরঞ্চ যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মোবাইলে বাড়তি কর আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
{মোবাইল ফোন সেবায় বাংলাদেশে করের পরিমাণ সর্বোচ্চ দাঁড়াবে ৩৯ শতাংশে। যা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মধ্যে সর্বোচ্চ। মোবাইলে কর আরোপ, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। শুল্ক না বাড়িয়ে ব্যবহার বাড়ালে রাজস্ব আয় আরো বাড়তো বলে মনে করেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা। নতুন করে এ খাতকে করের আওতায় আনা দেশীয় উদ্যোক্তারা শুধু নিরুৎসাহিতই হবে না, আগ্রহও হারিয়ে ফেলবে। একই সঙ্গে ইন্টারনেটের দাম গ্রাহক পর্যায়ে বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে}
বর্তমান বাজেটে রাজস্ব আদায়ের আওতা বৃদ্ধি করতে মোবাইলে কথা বলতে বাড়তি কর আরোপ করা হয়েছে। মোবাইলে কথা বলতে বেশি অর্থ গুনতে হবে এখন ভোক্তাকে। বর্তমানে একজন ভোক্তা মোবাইলে ১০০ টাকা
রিচার্জ করলে ৭৩ টাকার কথা বলতে পারেন। বাকি ২৭ টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হিসেবে কেটে নেয় মোবাইল অপারেটরগুলো। প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল সেবার ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। ফলে ভোক্তা ১০০ টাকায় ৬১.৩৫ টাকার কথা বলতে পারবেন। এদিকে মোবাইলে কথা বলা (ভয়েস কল), ইন্টারনেট ব্যবহার (ডাটা) ও মোবাইল ফোন উৎপাদানে শুল্প আরোপ হলে রাজস্ব বাড়ার পরিবর্তে আরো কমবে। শুল্ক না বাড়িয়ে বরং ব্যবহার বাড়ালে রাজস্ব বাড়বে বলেও মনে করছেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা।
২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেটে দাম বেড়েছে বেশ কয়েকটি পণ্যের। সিম কাড, মোবাইল টকটাইমের উপর শুল্ক বাড়ানো হয়েছে বেশি। ২০৪১ সাল নাগাদ তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে যে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের কথা বলা হয়েছিলো তা যথাযথ পরিকল্পনা দক্ষ মানবসম্পদ তৈরী করতে না পারলে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো কখনো সম্ভব হবে না। দক্ষ মানবসম্পদ কবে নাগাদ তৈরী হবে এমন পূর্বাভাস না থাকলেও সিম কার্ড ও মোবাইল টকটাইমের উপর শুল্ক বাড়ানো হয়েছে বেশি। এসব পণ্য ও পণ্যের উপকরণে শুল্ক বাড়ানো এবং ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব থাকছে বর্তমান বাজেটে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোবাইলের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে সিমের ওপর ভ্যাটের পরিমাণ ২০০ টাকা। সামনে এই হার ১০০ টাকা বা ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া মোবাইল ফোনে কথা বলা, ইন্টারনেটের ওপর সম্পূরক শুল্ক ও মোবাইল ফোন উৎপাদনের খরচও বাড়ানো হয়েছে।
বাজেটে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী মোবাইল সিমের দাম বাড়বে। কারণ প্রতিটি সিম কার্ড বিপরীতে মূল্য সংযোজন কর দুশো টাকার পরিবর্তে তিনশ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আবার মোবাইল ফোনের সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে যেসব সেবা দেয়া হয় অর্থাৎ কথা বলা কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহার-এসব ক্ষেত্রেও মানুষের ব্যয় বাড়বে।
কারণ অর্থমন্ত্রী এ ধরনের সেবার বিপরীতে বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক পনের শতাংশ থেকে বাড়িয়ে বিশ শতাংশে নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন। এর ফলে বেড়ে যাবে টকটাইম ও ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ। অর্থাৎ মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখন মানুষকে আগের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে। দেশে এখন প্রায় বিশ কোটি মোবাইল ফোন আছে। অনেকে একাধিক ফোন ব্যবহার করে থাকেন।
২০১৫-১৬ সালের বাজেটে প্রথমবার মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর সম্পূরক শুল্ক নিয়ে আসা হয়। প্রথমে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক দিলেও পরে তা ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয় বিভিন্ন পক্ষের দাবির প্রেক্ষিতে। কিন্তু দুই বছর বাদেই কিন্তু আবার এই শুল্ক ৫ শতাংশ করে দেওয়া হয়। পরে ২০১৯ সালে তা ১০ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ১৫ শতাংশ করা হয়। মাঝে যোগ করা হয়েছে ১ শতাংশ সারচার্জ। বাড়তে বাড়তে এই খাতে কর এখন ৩২ দশমিক ৫ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে। নতুন বাজেটে শুল্ক আরোপ হলে তা ৩৯ শতাংশে পৌঁছাবে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ করার প্রস্তাবে টকটাইম ও ইন্টারনেট ব্যবহারে ১০০ টাকায় বাড়তি গুনতে হবে প্রায় ৬ টাকা। বর্তমানে মোবাইলে কথা বলায় ১০০ টাকার রিচার্জে ৩৩ টাকার বেশি কর দেন গ্রাহকরা। একই পরিমাণ কর দিতে হয় ইন্টারনেটেও। বাজেটে উভয় ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে অতিরিক্ত ৫ দশমিক বৃদ্ধির ফলে ১০০ টাকার মোবাইল সেবায় সর্বমোট কর দিতে হবে ৩৯ টাকা, যা হবে দক্ষিণ এশিয়ায় সবোর্চ্চ। একইভাবে বর্তমান সিম ট্যাক্স ২০০ টাকা থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এভাবে ভ্যাট বাড়াতে থাকলে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করা কষ্ট হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন ব্যবহারকারীরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন শুল্ক আরোপ হলে মোবাইল ফোন সেবায় বাংলাদেশেই করের পরিমাণ সর্বোচ্চ দাঁড়াবে ৩৯ শতাংশে। অন্যদিকে বর্তমানে নেপালে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ, শ্রীলংকায় ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ, ভারতে ১৮ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৯ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৭ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৬ শতাংশ ও পাকিস্তানে রয়েছে সর্বোচ্চ কর ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
এছাড়া, স্থানীয় পর্যায়ে মোবাইল ফোন উৎপাদনে বর্তমানে সবমিলিয়ে ২৬ শতাংশ ও আমদানি করা মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে ৫৭ শতাংশ শুল্ককর দিতে হয়।
জানা গেছে, স্থানীয় ও আমদানি করা মোবাইল ফোনে করের হার বাড়তে পারে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বর্তমানে স্থানীয় কম্পানিগুলো মোবাইল ফোনের চাহিদার ৯৭ শতাংশই জোগান দিচ্ছে। ২০২১-২২ সালে এ খাতে অনেক বিনিয়োগ এসেছে উল্লেখ করে তাঁরা বলছেন, নতুন করে ভ্যাট আরোপ করলে এসব বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়বে এবং বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে।
২০৪১ সাল নাগাদ দেশের ডিজিটাল অর্থনীতির আকার ৫০ বিলিয়ন ডলার দাঁড়াবে। এ জন্য তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতির মতো আরো কিছু প্রনোদনা ও নীতিসহায়তা প্রয়োজন। কর অব্যাহতির আওতায় সার্চ ইঞ্জিন, অপটিমাইজেশন সার্ভিস, ওয়েবসাইট হোস্টিং, আইটি প্রসেস আউটসোর্সিং ও নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ককে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বর্তমানে দেশের ক্লাউড সার্ভিস এবং ওয়েব হোস্টিং ব্যবসার মাত্র ১০ শতাংশ দেশীয় উদ্যোক্তাদের দখলে রয়েছে। তাই নতুন করে এ খাতকে করের আওতায় আনা হলে তা দেশীয় উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করতে পারে। একই সঙ্গে নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ককে কর অব্যাহতির আওতায় আনা না হলে ইন্টারনেটের দাম গ্রাহক পর্যায়ে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রধান উপকরণ হিসেবে কাজ করবে দেশের আইসিটি খাত। এ খাতকে সরকার যত বেশি সহায়তা দেবে, স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য তত দ্রুত পূরণ হবে। বাজেটে এই খাতের অপ্রাপ্তিগুলোকে দ্রুত পুনর্বিবেচনা করলে পরোক্ষভাবে সরকার ও দেশের জন্যই উপকার হবে।
লেখক: সাংবাদিক