![](https://amarkagoj.com/wp-content/uploads/2024/04/2544211.jpg)
আসিফ হায়দার
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি ভালো পর্যায়ে রাখা যেকোনো দেশের অর্থনিতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এ রিজার্ভের মাধ্যমে একটি দেশ তার আমদানি ব্যয় পরিশোধ করে ও অন্যান্য দেশ ও দাতা সংস্থা হতে প্রাপ্ত ঋণের দায় মেটানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি দেশ নানা উপায়ে সংগ্রহ করতে পারে। এর পাশাপাশি নানা আন্তর্জাতিক লেনদেনের কাজেও এ রিজার্ভ ব্যবহার করা হয়। মূলত রপ্তানী আয় বিদেশে কর্মরত নাগরিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স হতে একটি দেশের রিজার্ভ গড়ে উঠলেও এর পাশাপাশি প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) ও বিদেশি ও দাতা সংস্থা হতে প্রাপ্ত ঋণ ও অর্থ সহায়তা এ রিজার্ভ বৃদ্ধিতেও ভ‚মিকা রাখে। সুতরাং আমদানী নির্ভর দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি ভালো অবস্থানে রাখা আবশ্যক।
বিগত প্রায় দুই বছর ধরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কভিড-১৯ এর সময়য় ২০২১ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা তার সর্বোচ্চ পরিমানের রেকর্ড করে যা ৪৮ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়ায়। এই রিজার্ভ বৃদ্ধির মূল কারণ ছিলো কভিড-১৯ এর লকডাউনের কারণে হুন্ডির দৌরাত্ম্য কমে যাওয়া যার ফলে প্রবাসী শ্রমিকগণ বৈধ উপায়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাতে বাধ্য হয়। এ বিপুল পরিমান রিজার্ভ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে বিনিয়োগ করা হয়। কিন্তু ২০২২ এর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বৈশ্বিক সংকট দেখা দেয় ও আমদানী-রপ্তানীর পরিবহন ব্যয় বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। যার ফলে বাংলাদেশের রিজার্ভ অতি দ্রুত ব্যয় হতে থাকে ও ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ২০২৩ এর জুন মাসে আইএমএফ এর পরামর্শে রিজার্ভ গণনার পদ্ধতিতে বিপিএম৬ পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪.৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে এসে দাঁড়ায় বিপিএম৬ মানদন্ড অনুযায়ী। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ এর মার্চে এ রিজার্ভ ১৯.৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
দেশের রিজার্ভ কমে যাওয়ার মূল কারণ দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে আমদানী ব্যয় বেড়ে যাওয়া ও হুন্ডির দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-২০, ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানী ব্যয় যথাক্রমে ৫৪.৭৮, ৬৫.৬০, ৮৯.১৬ ও ৭৮.৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিলো। এ তথ্য থেকে উপলব্ধি করা যায় যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সংকটে দেশের আমদানী ব্যয় বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমদানী সংকোচন নীতি গ্রহণ করায়, আগের অর্থবছরে আমদানী ব্যয় কমেছে। অন্যদিকে একই অর্থবছরগুলোতে রপ্তানি আয় যথাক্রমে ৩৬.৯২, ৪০.৬৪, ৫২.৪৭ ও ৫০.৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিলো। এ তথ্য বিবেচনায় নিলে দেখা যায় যে প্রায় প্রতি বছরেই ২০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি থাকছে। এ বাণিজ্য ঘাটতি মেটানোর জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা আবশ্যক। একই অর্থবছরগুলোয় রেমিট্যান্স আয় ছিলো যথাক্রমে ১৮.২১, ২৪.৭৮, ২১.০৩ ও ২১.৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে ইআরডি এর তথ্যমতে একই অর্থবছরগুলোতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ব্যয় যথাক্রমে ১.৭৩, ১.৯১, ২.০১ ও ২.৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ এ ব্যয় প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে ও আসছে অর্থবছরগুলোতেও বৃদ্ধি পাবে। এ চিত্রগুলো থেকে এটা প্রতিয়মান হচ্ছে যে সামনের বছরগুলোতে রিজার্ভে বড় ধাক্কা আসতে পারে। যার কারণে এখনই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপ্রদান করা আবশ্যক এবং সেই অনুযায়ী নীতি নির্ধারণ করতে হবে।
রিজার্ভের ক্ষয় ঠেকানোর জন্য সরকার আমদানী সংকোচন করেছে। যার ফলে দেশে পণ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর ফলে দেশে মূল্যস্ফিতি দেখা দিয়েছে যা বিগত ১৩ মাস ধরে ৯% উপরে রয়েছে। অন্যদিকে রিজার্ভ কমে যাওয়ায় কাঁচামাল আমদানী ব্যহত হচ্ছে ও দেশীয় মুদ্রা অবমূল্যায়নের ফলে দেশে উৎপাদন কমে গিয়েছে। এর প্রতিফলন ঘটেছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৭৮% তে নেমে আসায়। এভাবে বেশিদিন চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতিতে স্থবিরতা তৈরি হবে। যার ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে দেশ যে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় চলছিলো সেখানে ভাটার টান আসতে পারে। সুতরাং সফলতার সাথে দেশে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করার পর দেশের বর্তমান সংকট উত্তরণের চ্যালেঞ্জ এ সরকারকে দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করতে হবে।
রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্য সর্বপ্রথম আমাদের রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির দিকে সুনজর দিতে হবে। এর জন্য বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থির না রেখে বাজার ভিত্তিক করে দেওয়া উচিত। এর ফলে সাময়িকভাবে হয়তো দেশীয় মুদ্রার মান পড়ে যাবে কিন্তু এ মান পড়ে গেলে প্রবাসীরা বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠাতে শুরু করবে। কার্ব মার্কেটের সাথে বিনিময় হারের পার্থক্য কমে আসলে প্রবাসীরা বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠাতে উদ্বুদ্ধ হবে। এর পাশাপাশি তাদের জন্য কিছু নন-ক্যাশ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাছাড়া তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করলেও রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি সম্ভব। অন্যদিকে রপ্তানী বৃদ্ধির জন্য এর বৈচিত্রকরণ ও বাজার বহুমুখীকরণ আবশ্যক। আমাদের রপ্তানী আয়ের প্রায় ৮০-৮৫% আয়ের উৎস তৈরি পোশাক খাত। একটি খাতের উপর দেশের রপ্তানীর নির্র্ভশীলতা কখনোই অর্থনীতির জন্য সুদৃঢ় ভিত্তি তৈরি করে না। পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট (পিআরআই) অতি সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখায় যে বাংলাদেশে ৩৪৬টি তৈরি পোশাক বহির্ভূত পণ্য আছে যার প্রত্যেকটি পণ্যই এক মিলিয়ন বার্ষিক আয় করতে সক্ষম। কিন্তু এন্টি এক্সপোর্ট বায়াস তথা দেশীয় বাজারকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য তাদের যে সুরক্ষা দেওয়া হয়, তার ফলে তারা দেশীয় বাজারে পণ্য বিক্রয় করে লাভ করতে সক্ষম হয় ও বিদেশে বাজার সম্প্রসারণ করতে আগ্রহী নয়। সুতরাং বাংলাদেশের দেশীয় বাজারে প্রটেকশন নীতিতে পরিবর্তন প্রয়োজন। তাছাড়া এলডিসি উত্তরণের পর রপ্তানী খাতে সরাসরি ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। এর পরিবর্তে সরকারের ব্যবসার খরচ কমানোতে গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। পাশাপাশি সরকার শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। শুধু রপ্তানী পণ্যেই নয়, রপ্তানী গন্তব্যেও বৈচিত্র আনয়ন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। রপ্তানী গন্তব্য বৈচিত্রপূর্ণ হলে নানারকমের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। এর পাশাপাশি আন্দার-ইনভয়েসিং ও ওভার-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচাররোধে শক্ত পদক্কেপ গ্রহণ করতে হবে।
রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখার অন্যতম শর্ত হচ্ছে আমদানী নির্ভরতা কমানো। দেশে উচ্চফলনশীল ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য আমদানী কমাতে হবে। এর পাশাপাশি হিমাগার ব্যবস্থাপনার উন্নতি সাধন করে ফসল ও অন্যনান্য কৃষি পণ্যের পচন রোধ করতে হবে। জ্বালানী আমদানীর উপর নির্ভরতা কমানোর জন্য বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এর গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য শক্তি সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করতে পারলে ২০২৩ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত সরকারের জন্য ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নানা ধরণের ভর্তুকি ও আমদানী ব্যয় বাবদ সাশ্রয় হবে। অন্য এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে নবায়নযোগ্য জ্বালানী প্রতিবছর সরকারের জন্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে। তাছাড়া নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তর ঘটলে নানা ধরণের বৈশ্বিক কমপ্লায়েন্স মানতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ যা বিদেশে বাংলাদেশের বাজার সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এর সাথে দেশের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনয়ন অতীব জরুরী। খেলাপিঋণ কমানোর উপর জোড় দিতে হবে। এফডিআই আকর্ষনের জন্য দেশের অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনয়ন করতে হবে। আবশ্যকীয় প্রকল্পগুলো বাদে কিছু প্রকল্পের কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা যেতে পারে। বৈদেশিক সহায়তা বৃদ্ধির জন্য দেশের অর্থনৈতিক কূটনীতির কৌশল সাজাতে হবে এবং ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মানে তাঁরই সুযোগ্য তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এক দুর্বার অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় আসীন হয়েছে। তবে নানা বৈশ্বিক সমস্যার কারনে দেশের অর্থনীতিতে কিছু সংকট দেখা দিয়েছে যা সঠিক ও সময়োপযোগী কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে উত্তরণ সম্ভব। আমরা আশা রাখি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে সকল সংকট কাটিয়ে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত হবে।
লেখকঃ গবেষণা সহযোগী, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)।