মোহাম্মদ খলিলুর রহমান
ঢাকা জেলার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন জনপদ বাজিতপুর ও নিকলী। ১৭৮৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা সৃষ্টির পর বাজিতপুর ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। বাজিতপুর থানা স্থাপিত হয় ১৮২৩ সালে। তখনও কিশোরগঞ্জ থানার সৃষ্টি হয়নি। ১৮৬৭ সালে বাজিতপুরে দেওয়ানী আদালত হয়। সে সময় বাজিতপুরের আয়তন ছিল ৪৪৩ বর্গ মাইল। ১৮৭২ সালে আদমশুমারি অনুযায়ী বাজিতপুরে জনসংখ্যা ছিল ১,৫৬,৭৯১ জন। অষ্টগ্রাম, কুলিয়ারচর, ভৈরব তখন বাজিতপুর থানার অন্তর্গত ইউনিয়ন ছিল। ১৯০৬ সালে অষ্টগ্রাম এবং ভৈরব থানা হয়। ১৯২২ সালে কুলিয়ারচর থানা হয়। ১৮৬০ সালে কিশোরগঞ্জ বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার একটি মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
ব্রিটিশ সরকার ১৯১২ সালে তৎকালীন কিশোরগঞ্জ মহকুমা কে দুই ভাগ করে বাজিতপুরকে মহকুমা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে লক্ষ্যে ওই বছরই বাজিতপুরে প্রায় ২০৬ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়। সে সময় প্রশাসনিক ভবন, অবকাঠামো নির্মাণের জন্য স্থান নির্ধারণসহ নানা প্রক্রিয়া চালানোর একপর্যায়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ফলে মহকুমাকরণ প্রক্রিয়া থেমে যায়।
১৮২৩ সালে ব্রিটিশ সরকার বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলায় ‘বাজিতপুর’ ও ‘হয়বতনগর’ নামে দুটি থানা প্রতিষ্ঠা করে। পরে হয়বতনগরকে কিশোরগঞ্জ এবং বাজিতপুরকে ভেঙে আরও কয়েকটি থানা প্রতিষ্ঠা করা হয়।
প্রস্তাবিত ‘বাজিতপুর মহকুমার’ পুরনো দলিলপত্র পর্যালোচনা করে জানা যায়, বাজিতপুরকে মহকুমায় রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯২২ সালে লেভিঞ্জ কমিশন, পাকিস্তান সরকার ১৯৫২ সালে তিন সদস্যের হাসান বাউন্ডারি কমিশন ও বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে অবিভক্ত ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক রফিউল করিমের নেতৃত্বে তিনটি পৃথক কমিশন গঠন করে। এ তিনটি কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনেই ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে মহকুমা করার যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয় এবং সুশৃঙ্খল প্রশাসন কার্যকরী করতে এ অঞ্চলের মধ্যবর্তী থানা বাজিতপুরেই মহকুমা স্থাপন জরুরি বলে মতামত দেওয়া হয় এবং তা অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়। আশপাশের এলাকার জনগণের দুর্ভোগ লাঘবের বিষয়টিও এতে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া বাজিতপুরে যুগ্ম জেলা জজ আদালত স্থাপনের জন্য ২০০৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (মতামত) সরেজমিন তদন্ত শেষে একটি প্রতিবেদন প্রদান করেন। যাতে বাজিতপুরে যুগ্ম জেলা জজ আদালত স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে।
এই জনপদের মানুষের শত শত বছরের লালিত স্বপ্ন বাজিতপুর জেলা হবে। সে যৌক্তিকতার মাঝে তিলে তিলে গড়ে উঠা জেলা হওয়ার সব প্রক্রিয়াই চল ছিল। তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখেন বাজিতপুরের খ্যাতি সন্তান আলহাজ্ব জহুরুল ইসলাম। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসলে তিনি তার স্বরনাপন্ন হয়ে বাজিতপুর জেলা হবার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। জিয়াউর রহমান এই সময় কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক রাফিউল করিম বাজিতপুর জেলা করার ব্যপারে প্রয়োজনীয় রিপোর্ট দিতে বলে। তিনি ৬ টি উপজেলার সমন্বয়ে বাজিতপুর জেলা সদরে উপযুক্ত স্থান বলে উল্লেখ করেন রিপোর্ট পাঠান। তার কিছুদিন পর জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হলে জেলা হবার প্রক্রিয়া থেমে যায়। ১৯৮২ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসলে জহুরুল ইসলাম চেষ্টা আবার জেলা হবার একটি সুবর্ণ সুযোগ আসে। তথাকথিত বাজিতপুরের কিছু বুদ্ধিজীবী ও কিশোরগঞ্জ সদরের বিরোধিতার কারণে এবারও জেলা হওয়ার স্বপ্ন ধূলিষাত হয়।
মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ২০১০ সালের ভৈরবে হাজী আসমত কলেজ মাঠে এক সমাবেশে ভৈরবকে জেলা করার ঘোষণা দেন। সরকার ভৈরবকে জেলা ঘোষণার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এমন খবরে কিশোরগঞ্জের অখÐতা রক্ষার দাবিতে আন্দোলনে নামে জেলাবাসী। একই সময়ে আন্দোলনে নামে বাজিতপুরবাসীও। তাদের দাবি, বাজিতপুরকে জেলা করার দাবি দীর্ঘদিনের। নতুন জেলা হলে সেটা বাজিতপুরই হবে। এই দাবিতে বাজিতপুরের সর্বস্তরের জনতা নৌপথ, রেলপথ, সড়ক পথসহ অবরোধ, হরতাল ও অনশন কর্মসূচি পালন করে।
বাজিতপুরের খ্যাতি সন্তান বিশ্ববরেণ্য হাইড্রোগ্রামীন প্রকল্পের উদ্ভাবক ড. রাস বিহারী ঘোষ ২০২২ সালে হতে বাজিতপুরকে জেলা করার যৌক্তিক দাবি নিয়ে জোর প্রচার চালাছেন। সভা সমাবেশ সহ ৬ উপজেলায় ব্যানার ফেস্টুন জানান দিচ্ছেন কেন বাজিতপুর কে জেলা করতে হবে।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বাজিতপুর জেলা বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় বাজিতপুরের ড. ঘোষ সাইন্স এন্ড টেকনোলজি ক্যাম্পাসে।
আলোচনা সভায় বাজিতপুর বার কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি প্রবীণ আইনজীবী শৈলেশ্বর দাসের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হাইড্রোগ্রামীন প্রকল্পের উদ্ভাবক ড. রাস বিহারী ঘোষ।
সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট আ. রহমান বোরহান, এডভোকেট শেখ নূরুন্নবী বাদল, অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ দাস, মো. মোবারক হোসেন, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিল্টন, শ্রী মনোরঞ্জন দাস, অধ্যাপক মো. ওয়াহিদুজ্জামান, সহকারী অধ্যাপক কন্টি রাম দাস, মো. লিয়াকত আলী নান্টু, শিক্ষাবিদ নাসিমা রহমান প্রমুখ।
বিশ্ব বরেণ্য পানি বিজ্ঞানী ড. রাসবিহারী ঘোষ প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, “মুঘল আমলে বাজিতপুরে মসলিন কাপড়ের সুনাম ছিল বিশ্বজুড়ে। ব্রিটিশ আমলে দিলালপুর নদীবন্দর উপমহাদেশে বিখ্যাত ছিল। এখানে প্রতিদিন শত শত জাহাজে মানুষ আসত ব্যবসা-বাণিজ্য করতে। ১৮২৩ সালে ব্রিটিশ সরকার ময়মনসিংহ জেলায় ‘বাজিতপুর’ ও ‘হয়বতনগর’ নামে দুটি থানা প্রতিষ্ঠা করে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৬৯ সালে বাজিতপুর পৌরসভা স্থাপিত হয়। ১৯১২ সালে বাজিতপুরকে মহকুমা করার লক্ষে বাজিতপুরে প্রায় ২০৬ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বাজিতপুরকে মহকুমাকরণ প্রক্রিয়া থেমে যায়।’
রাস বিহারী ঘোষ আরো বলেন, একবিংশ শতাব্দীর চাহিদা পূরনে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে বৃহত্তর বাজিতপুর বাসির প্রাণের দাবি বাজিতপুর জেলা কারার। দুই শতবর্ষের লালিত স্বপ্নে যুগে যুগে অসংখ্য জ্ঞানী গুণী শ্রম দিয়েছে বাজিতপুর জেলার দাবিতে। এই লড়াইয়ে সর্বশেষ যুদ্ধ বলছেন রাস বিহারী ঘোষ নিজেকে। তিনি বলেন ভৈরব, কুলিয়ারচর, বাজিতপুর, নিকলি, অষ্টগ্রাম ও কটিয়াদি উপজেলাবাসীর সহযোগিতা পেলে আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি আইনি লড়াই চালিয়ে যাবে।