এক যুগ ধরে ফাইলচাপা দুদকের তদন্ত
আমার কাগজ প্রতিবেদক
রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীতে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে ‘হোটেল শেরাটন’। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই সেটি গড়ে তোলা হয়েছিল। অথচ এই জমির মালিক সিটি করপোরেশন। সেখানে ১৪ তলার চুক্তি করে ২৮ তলা ভবন বানিয়ে ভোগদখল করছে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান। বহু বছর আগেই এ নিয়ে অভিযোগ ওঠে। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তদন্তের জন্য নথি খোলে। উচ্চ আদালতে মামলাও হয়েছে। তবে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটির মালিক পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের অন্যতম দোসর হওয়ায় কোনো তদন্তই আলোর মুখ দেখেনি। বরং সরকার পরিবর্তনের পর এখন সেটিকে বৈধতা দিতে তোড়জোড় চলছে।
অভিযোগ আর নথি পর্যালোচনায় এ নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। জানা গেছে, বনানী থেকে গুলশান-২ যাওয়ার পথে প্রধান সড়কের পাশে এ জায়গাটি সিটি কর্পোরেশনের। এটি বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৮৪ সালে তদানীন্তন ঢাকা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) একটি কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণের জন্য প্রায় তিন বিঘা (৬০ কাঠা) আয়তনের ৪৪ নং প্লটটি (বর্তমানে কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ) ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন বরাবর বরাদ্দ প্রদান করে। বরাদ্দ প্রাপ্তির পর মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষ উক্ত প্লটের আংশিক জমিতে ১৬ তলা ভিত্তি সম্বলিত একটি বেইজমেন্টসহ তিনতলা মার্কেট কাম আবাসিক ভবন নির্মাণ করে। ২০০৬ সালের দিকে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে সেখানে একটি ১৩ তলা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ওই বছরের ৭ মে এ বিষয়ে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান ‘বোরাক রিয়েল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেড’-এর সঙ্গে চুক্তিও স্বাক্ষর হয়। প্রসঙ্গত, বোরাক রিয়েল এস্টেটের মালিক প্রভাশালী আওয়ামী লীগ নেতা নূর আলী। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ৪৪ কাঠা জমির ওপর নির্মিত ভবনের ৩০ ভাগ হিস্যা থাকবে সিটি কর্পোরেশনের এবং বাকী ৭০ ভাগ উদ্যোগী সংস্থা বোরাক রিয়েল এস্টেটের। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হবার পরই মওকা পেয়ে যান নূর আলী। তিনি পূর্বের চুক্তি সংশোধন করে ১৩ তলার পরিবর্তে ১৪ তলা ভবন নির্মাণের অনুমতি বাগিয়ে নেন। বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, ভবন নির্মাণের পর চুক্তির শর্ত মোতাবেক সিটি কর্পোরেশনের প্রাপ্য হিস্যা বুঝিয়ে দেননি। বরং ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অব্যবহৃত ১৬ কাঠা জমির ওপর ২৮ তলা ভবন বানিয়ে সেখানে ‘শেরাটন’ নামের পাঁচ তারকা হোটেলের একচেটিয়া ব্যবসা করছেন। অথচ সিটি কর্পোরেশনের জন্য কোন হিস্যা রাখা হয়নি। আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য হচ্ছে, কোন ভবন নির্মাণেই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কিংবা সংশ্লিষ্টদের অনুমোদন নেয়া হয়নি। তাছাড়া বিমানবন্দরের রানওয়ের অ্যাপ্রোচ ফানেল এলাকায় নির্ধারিত সীমার বাইরে সুউচ্চ ২৮ তলা বভন নির্মাণ করা হলেও সংশ্লিষ্টদের তরফে কোন বাধা দেয়া হয়নি।
বোরাক রিয়েল এস্টেটের সঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের অসম এই চুক্তি নিয়ে তখনই ব্যাপক সমালোচনা হয়। সংসদীয় কমিটিতেও আলোচনা হয়। তবে কোন সুরাহা হয়নি। ক্ষমতাসীনদের চাপে দুদকও হাত গুটিয়ে বসে থাকে। এ অবস্থায় চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান চেয়ে ২০২৩ সালের জুন মাসের প্রথমার্ধে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। এর আগে পদক্ষেপ চেয়ে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেন একই আইনজীবী। তবে কোন কিছুরই তোয়াক্কা করেনি বোরাক রিয়েল এস্টেট সংশ্লিষ্টরা।
চুক্তিতেও শুভংকরের ফাঁকি
নথি পর্যালোচনায় জানা গেছে, ২০০৬ সালের মে মাসে প্রথম চুক্তি হয়েছিল। ১৩ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয় ২০০৭ সালের জুলাইয়ে। চুক্তি অনুযায়ী ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ভবন নির্মাণের কাজ শেষ করে করপোরেশনকে তাদের প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। তবে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে ডেভেলপার কোম্পানি ২০০৯ সালের ১৮ মে চুক্তি সংশোধনের জন্য তৎকালীন ডিসিসির কাছে আবেদন করে। উক্ত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ডিসিসির বাজার সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী স্বাক্ষরিত এক স্মারকে একই বছরের ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে ডেভেলপার কোম্পানিকে সংশোধন প্রস্তাব পেশ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। ২০১০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সংশোধিত প্রস্তাব পেশ করে ডেভেলপার কোম্পানি। পরে ওই বছরের ৬ অক্টোবর উভয়পক্ষের মধ্যে সংশোধিত চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
মূল চুক্তিতে বেজমেন্ট পার্কিংয়ের ১০০ ভাগ ডিসিসির শেয়ার ছিল। সংশোধিত চুক্তিতে ডেভেলপার কোম্পানিকে বেজমেন্ট পার্কিংয়ের শেয়ার প্রদান করা হয়েছে। মূল চুক্তিতে লেভেল ১৩ পর্যন্ত শেয়ার বণ্টন করা হয়েছিল। সংশোধিত চুক্তিতে লেভেল ১৪ নির্মাণের কথা উল্লেখ করে তার শতভাগ শেয়ার ডেভেলপারকে দেওয়া হয়। মূল চুক্তিতে ডেভেলপারের প্রাপ্য জমির পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ৯৯ কাঠা। সংশোধিত চুক্তিতে ডেভেলপারের প্রাপ্য জমির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১৯ দশমিক ১৭ কাঠা। চূড়ান্ত নকশা অনুমোদনের দিন থেকে মার্কেট নির্মাণকাল ছিল ৩০ মাস। সংশোধিত চুক্তিতেও নির্মাণকাল দেখানো হয়েছে ৩০ মাস। কিন্তু এই ৩০ মাস গণনা কখন থেকে শুরু হবে তা স্পষ্ট নয়। আরো মজার বিষয় হচ্ছে, ওই জায়গায় আগে থেকেই ১৬ তলা ফাউন্ডেশনসহ লেভেল-১, ২ ও ৩ তলা মার্কেট ভবন ডিসিসি নিজস্ব অর্থে নির্মাণ করলেও ওই তিনটি ফ্লোরে ডেভেলপারকে ৭০ ভাগ হিস্যা দেয়া হয়েছে।
অবৈধকে বৈধতা দিতে তোড়জোড়
‘সরকারি জমিতে পাঁচ তারকা হোটেল’ গড়ে রমরমা ব্যবসা নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। সরকারের অডিট বিভাগের নিরীক্ষায়ও অনিয়ম-জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে। তবে সেসবে পাত্তা দেয়নি বোরাক রিয়েল এস্টেট সংশ্লিষ্টরা। বরং অন্তর্বর্তী সরকার যেন তাদের জন ‘শাপে বর’ হয়ে এসেছে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হাইভোল্টেজ তদ্বির চালান। সফলতার মুখও দেখা শুরু হয়েছে। পুরো প্রক্রিয়ার জালিয়াতিকে বৈধতা দিতে এরই মধ্যে কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। বিষয়টি সুরাহা করতে মন্ত্রণালয় থেকে কমিটিও করা হয়েছে। কমিটির কার্য পরিধি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও বোরাক রিয়েল এস্টেটের শেয়ার বন্টনের বিষয়টি নিষ্পত্তি। চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি উক্ত কমিটির এক সভায় কিছু সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ছাড়পত্র পাবার অংশ হিসেবে গত ৭ এপ্রিল বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও পরিবেশ অধিদপ্তর বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে। মূলতঃ হিস্যা পুনর্নির্ধারণের আড়ালে পুরো অনিয়মকে জায়েজ করার মিশন চলছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
