আমার কাগজ প্রতিবেদক
হাওরের এই ফুটবলকন্যাদের দায়িত্ব এখন বসুন্ধরা গ্রুপের
দক্ষিণে টাঙ্গুয়ার হাওর, উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড় আর মধ্যখানে একটি গ্রাম। সেই গ্রামের শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির নাম কলাগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা কলাগাঁও গ্রামে বিদ্যালয়টির অবস্থান। গ্রামের কিছু পরিবার কয়লা ও চুনাপাথর ব্যবসা করে ধনী হলেও বেশির ভাগ মানুষই শ্রমজীবী।
বিদ্যালয়টিতে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান চলে। এই এলাকায় বাল্যবিয়ের হার বেশি। গত কয়েক বছরে মেয়েদের ফুটবল খেলা এই বাল্যবিয়েহ অনেকটাই কমিয়ে এনেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের একটি তুখোড় ফুটবল দল আছে।
দরিদ্র পরিবারের এই কৃতী ফুটবলদলের মেয়েদের বেশির ভাগই পরবর্তী সময়ে খেলা ও লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ে। তাদের পড়ালেখা আর খেলাধুলা চালিয়ে যেতে এই কৃতী ফুটবলদলের মেয়েদের দায়িত্ব নিয়েছে বসুন্ধরা শুভসংঘ। ১৫ জন খেলোয়াড়কে পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়ার জন্য প্রতি মাসে বৃত্তি দেবে বসুন্ধরা গ্রুপ। ভালো খেলতে পারলে ও ভালোভাবে পড়ালেখা করলে প্রয়োজনে এ সহায়তা আরো বাড়বে।
যাতায়াতে দুর্গম সীমান্তঘেঁষা কলাগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খুদে মেয়ে ফুটবলদল এখন গ্রামের মেয়েদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে উন্নত জীবনের। শক্তি জুগিয়েছে আর মনোবল দিয়েছে এগিয়ে যাওয়ার। সীমান্তের নিভৃত এলাকায় বাতিঘর হয়ে উঠেছে কলাগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খুদে মেয়ে ফুটবলদলটি। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে ভালো করা দলটি এখন সুনামগঞ্জ জেলার মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে কলাগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়ে ফুটবলদল উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে টানা পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
একইভাবে বিভাগীয় পর্যায়ে তিনবার রানার্স আপ আর দুইবার তৃতীয় স্থান লাভ করেছে। কলাগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতিকুর রহমান বলেন, ‘বিদ্যালয় থেকে উপজেলা সদরের দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। বর্ষায় নৌকায় করে উপজেলা সদরে যাতায়াতে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। আবার হেমন্তে হেঁটে যাতায়াত আরো কঠিন। এই ফুটবলার মেয়েদের বেশির ভাগই দিনমজুর পরিবারের। আমরা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এই মেয়েদের লেখাপড়ার সঙ্গে ফুটবল খেলাটাও চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। প্রাথমিক পর্যায়ের পরই ওই মেয়েদের অনেকেই শিক্ষা ও খেলাধুলা থেকে ঝরে যায়। বসুন্ধরা গ্রুপ এই মেয়েদের লেখাপড়ার যাবতীয় দায়িত্ব নেওয়ায় ওরা এখন স্বাচ্ছন্দ্যে লেখাপড়া করতে পারবে। আবার খেলাধুলায়ও মনোযোগী হবে।’ সাবেক ফুটবলার এবং স্থানীয় হামিদ-হালিমা মডেল বিদ্যানিকেতনের পরিচালক সেলিম ইকবাল বলেন, ‘নিভৃত সীমান্তের বাতিঘর কলাগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েদের ফুটবলদল। আমরা চেষ্টা করব এই মেয়েদের লেখাপড়া ও ফুটবল খেলাটা চালিয়ে নেওয়ার। এখন বসুন্ধরা গ্রুপ দায়িত্ব নেওয়ায় খুব ভালো হলো। এখন ওরা পড়বে ও খেলবে নিশ্চিন্তে।’
তাহিরপুর উপজেলা ফুটবল উন্নয়ন সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবির হাসান মানিক বলেন, যেখানে হাওরাঞ্চলের মেয়েরা ঘরের বাইরে যেতে ভয় পায়, সেখানে এই মেয়েরা এখন জাতীয় ফুটবলদলে খেলার স্বপ্ন দেখছে। হাওরাঞ্চলে মেয়েদের জাগরণ ঘটেছে। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। এই খুদে মেয়ে খেলোয়াড়দের কারণেই বাল্যবিয়ে অধ্যুষিত সীমান্তবর্তী এলাকায় বাল্যবিয়েও কমেছে। বসুন্ধরা গ্রুপ এই মেয়েদের দায়িত্ব নেওয়া মানে ওরা দাঁড়িয়ে গেল। এখন নিশ্চিন্তে এগিয়ে যাবে মেয়েদের ফুটবলদলটি। উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হাফিজ উদ্দিন বলেন, তাহিরপুরের একটি দুর্গম অঞ্চলের খুদে মেয়ে ফুটবলদল হাওরাঞ্চলের মেয়েদের মনে শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। এই মেয়ে ফুটবলদলটি এখন জেলার মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হয়ে উঠেছে।
কলাগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবলদলের সাবেক অধিনায়ক বর্তমানে তাহিরপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী বিউটি আক্তার বলেন, ‘সব প্রতিকূলতা ভেদ করে আমরা খেলা শুরু করেছিলাম। ওই সময়ের বেশির ভাগ খেলোয়াড় লেখাপড়াটাও চালিয়ে যেতে পারেননি দরিদ্রতার কারণে। বসুন্ধরার উদ্যোগ এই খুদে খেলোয়াড়দের লেখাপড়া নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমা বলেন, ‘এই খুদে মেয়ে ফুটবলদলটি নিয়ে আমি গর্বিত। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এদের জাগরণ হাওরাঞ্চলের মেয়েদের মনে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে। এটিই বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের সার্থকতা। বসুন্ধরা গ্রুপ এদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছে। এটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এই মেয়েগুলো এখন মনে সাহস পাবে।’