
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক এক ভূখণ্ডের জন্মলাভ হয়-যার নাম বাংলাদেশ। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে দেশ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শিকার হয়। দুর্নীতি, প্রশাসনিক অদক্ষতা, খাদ্য সংকট এবং রাজনৈতিক সংঘাত সমাজে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেশকে সংকটে ফেলে। সেই সময়ে বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করে এবং জনগণের মধ্যে হতাশা এবং অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। একই সময়ে বিরোধীদলগুলোর কার্যক্রম সীমিত ছিল। রাজনৈতিক বৈচিত্র্য হ্রাস পাওয়ায় সমাজে উত্তেজনা তৈরি হয়। এই অস্থির পরিস্থিতির মধ্যেই ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ড। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা রাষ্ট্রকে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে। খন্দকার মোশতাক আহমেদ স্বল্পকালীন রাষ্ট্রপতি হন। ক্ষমতার জন্য সেনা অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের ধারাবাহিক ঘটনা দেশের রাজনৈতিক অবস্থা আরও জটিল করে তোলে। এই অস্থিরতার ভেতর জেনারেল জিয়াউর রহমান ধীরে ধীরে রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্বের কেন্দ্রে উঠে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বেতার থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তিনি জাতীয় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে ধারাবাহিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রপতি হন। ক্ষমতায় আসার পর তিনি বুঝতে পারেন যে, সামরিক শাসনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়। এজন্য তাঁকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গঠন করতে হবে, যা তাঁর শাসনের বৈধতা নিশ্চিত করবে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের চাহিদা পূরণ করবে। এই বাস্তবতা থেকে জিয়াউর রহমান “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” ধারণা তুলে ধরেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের জাতীয় পরিচয় গড়ে তোলা- ভৌগোলিক সীমানা, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের সমন্বয়ে। জিয়া দেশের জনগণকে একটি নতুন জাতীয়তাবাদী ভিত্তিতে সংগঠিত করার চেষ্টা করেন।বহুদলীয় রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে জিয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে বৈধতা দেন। নিষিদ্ধ দলগুলো পুনরায় সক্রিয় হয়। এরপর তিনি ভিন্ন মতাদর্শ, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তরের মানুষকে একত্রিত করে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পদক্ষেপ নেন।
বরেণ্য রাষ্ট্রনায়ক শহীদ জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে পুরুদ্ধার এবং জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। শহীদ জিয়ার গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা ছিলা সুগভীর। কালের পরিক্রমায় ৪৭ এ পদার্পণ করলো বিএনপি। একাত্তুর উত্তর বাংলাদেশ যুদ্ধ বিধ্বস্ত এক দেশ। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জনজীবন বিপর্যস্ত। এর মধ্যেই দেশের উপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে একদলীয় বাকশালের শাসন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের মানুষ দেখতে পেল তাদের স্বপ্ন ছিনিয়ে নিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। হৃত স্বপ্নকে ফিরিয়ে এনে দেশের মানুষের হাতে মুঠোয় পুরে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। সেই লক্ষ্যে তিনি গঠন করেন বিএনপি। এই দলটির জন্ম কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, সামাজিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং সামরিক নেতৃত্বের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গঠনের প্রয়োজনীয়তার যৌক্তিক ফল। বিএনপির সৃষ্টির পেছনে এমন একটি প্রক্রিয়া কাজ করেছিল, যা স্বাধীনতার পর দেশকে অস্থিতিশীলতা ও সংকটের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
বিএনপির গঠনতন্ত্রে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, বহুদলীয় অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জনগণের স্বার্থরক্ষা এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সংরক্ষণের বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পায়। দলটি দ্রæত জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। কারণ তখন জনগণ একদিকে বাকশালের একদলীয় শাসনের প্রতিক্রিয়া অনুভব করছিল এবং অন্যদিকে সামরিক শাসনের বৈধতা নিশ্চিত করতে একটি রাজনৈতিক দল প্রত্যাশা করছিল। বিএনপি শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তার ফল ছিল না, বরং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বাস্তবতাকেও সমন্বয় করেছিল। রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানের প্রথম বড় উদ্যোগ ছিল দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার গণতান্ত্রিকীকরণ। তিনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেন। এর মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ফিরে আসে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে তার এই উদ্যোগ দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। বিএনপির মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ইসলামি মূল্যবোধ এবং আধুনিক জাতীয়তাবাদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দর্শন প্রবর্তন করেন। এই দল আজও বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে আছে।
কৃষি উন্নয়নে তার অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের খাদ্য সংকট মোকাবিলায় তিনি “সবুজ বিপ্লব” চালু করেন। তিনি কৃষকদের মাঝে উন্নত বীজ, সেচ সুবিধা, সার এবং কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করেন। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিতে উৎপাদন বহুগুণে বাড়ে। এর ফলে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে অগ্রসর হয়, যা ছিল একটি বিশাল সাফল্য। তার কৃষি নীতির ফলে দেশের গ্রামীণ জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন আসে এবং দারিদ্র্য কমতে শুরু করে। শুধু কৃষি নয়, জিয়াউর রহমান শিল্প ও বাণিজ্য খাতের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখেন। তিনি রপ্তানিমুখী শিল্পনীতি গ্রহণ করেন, যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ভিত্তি স্থাপন করে। আজকের গার্মেন্টস শিল্প, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি, সেই সময়কার তার গৃহীত নীতিমালার ফল। তিনি সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করেন, যাতে উদ্যোক্তারা শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসে। ফলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার হয় এবং কর্মসংস্থান বাড়ে।
গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য তিনি একটি বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করেন, যার মাধ্যমে গ্রামীণ অবকাঠামো- যেমন রাস্তা, সেতু, স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণে জোর দেওয়া হয়। পাশাপাশি তিনি ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালু করেন, যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পারে। গ্রামে গ্রামে “স্বনির্ভরতা” অর্জনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়, যার মাধ্যমে গ্রামের মানুষ নিজস্ব শক্তিতে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যায়। এই কর্মসূচিগুলো দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। জিয়াউর রহমান দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী অবদান রাখেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা দেন, যা পরবর্তীকালে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (SAARC) হিসেবে বাস্তবায়িত হয়। তার ক‚টনৈতিক নীতির ফলে বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়। ইসলামী সম্মেলন সস্থার (OIC) সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে তিনি মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় আরও সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করতে শুরু করে।
সদ্য স্বাধীন অথচ দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি দুঃশাসন ও চরম রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিপতিত ডুবন্ত বাংলাদেশকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা প্রসঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলের বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তার ভাষায় “১৯৮১ সালের পরিবর্তে জিয়াউর রহমানকে ১৯৭৫ সালে হত্যা করা হলে বাংলাদেশের কী হতো তা কল্পনা করা কঠিন। আফগানিস্তান বা লাইবেরিয়ার মডেলে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারতো। জিয়া বাংলাদেশকে সেই পরিণতি থেকে রক্ষা করেছেন। যে কথা বলে শেষ করতে চাই, জাতীয়তাবাদী দর্শনের সঠিক উপলব্ধি ও এর বাস্তবায়নের লক্ষ্য অর্জনে জিয়া’র রাষ্ট্রভাবনা- বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, জনসম্পৃক্ত অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন (বিশেষ করে ১৯ দফা কর্মসূচির বাস্তবায়ন), জাতীয় সত্ত্বা ও স্বার্থ রক্ষা করে কর পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন এবং বহু দলীয় গণতন্ত্রের চর্চার কোন বিকল্প নেই। জনগণের নিরাপত্তা বিধানের জন্যই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত রোড ম্যাপ অনুযায়ী একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোন বিকল্প নেই। তাই জনপ্রিয় ও দায়িত্বশীল একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টাই হওয়া উচিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অঙ্গিকার।
বিএনপির প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়। এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বার্থসিদ্ধির জন্য হয়নি; বরং এটি ছিল জনগণের প্রত্যাশা পূরণের, দেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার এবং নতুন রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত তৈরির ফল। দলটি স্বাধীনতার পরবর্তী অস্থিরতার মধ্যে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে পুনরায় জীবন্ত করে তোলে। এটি দেশকে বহুদলীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে পুনঃসংযোগ করার কাজ করে। একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী দর্শনকে নতুনভাবে প্রচার করে জনগণকে সংগঠিত করে। ফলে বলা যায়, বিএনপি সৃষ্টির ঐতিহাসিক পটভূমি হলো মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী অস্থিরতা, একদলীয় শাসনের অভিজ্ঞতা, সামরিক নেতৃত্বের রাজনৈতিক উদ্যোগ, নতুন জাতীয়তাবাদী দর্শনের প্রবর্তন এবং আন্তর্জাতিক বাস্তবতার সমন্বয়। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়, যা আজও দেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করছে।
তবে দুর্ভাগ্যবশত, ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক অভ্যুত্থানের সময় তিনি নিহত হন। তার আকস্মিক মৃত্যু জাতির জন্য ছিল এক বড় ধাক্কা। দেশের মানুষ এক মহান নেতাকে হারিয়েছিল, যিনি কেবল রাজনৈতিক নেতা নন, বরং একজন স্বপ্নদ্রষ্টা ও নির্মাতা ছিলেন। তার মৃত্যু দেশের ইতিহাসে গভীর শোকের ছায়া ফেলে। আজও জিয়াউর রহমানের নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে সাহস, আত্মনির্ভরতা ও উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে উচ্চারিত হয়। তার জীবন আমাদের শেখায় কিভাবে সংকটময় সময়ে সাহসিকতার সাথে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে হয়। তিনি যে উন্নয়ন পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন, তা আজও বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে ফলপ্রসূ হচ্ছে। তার চিন্তা-চেতনা ও কর্মনীতিই আজকের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রেরণা।
লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি এবং রোটারি লার্নিং ফেসিলিটেটর, রোটারি ক্লাব, ঢাকা এলিট।