মোহাম্মদ খলিলুর রহমান
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলা পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান, ভাষা সৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ইয়াকুব মিয়ার পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে।
গতকাল শনিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে দীর্ঘদিনের কর্মস্থল বাজিতপুর সরকারি কলেজ মাঠে তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।
বাজিতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শামীম হোসাইন রাষ্ট্রের পক্ষে সালাম গ্রহণ করেন। এ সময় জাতীয় পতাকা দিয়ে আচ্ছাদিত মরহুমের মরদেহে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়। বাজিতপুর থানা পুলিশের একটি চৌকস দল তাকে গার্ড অব অনার দেয়। বিউগলে করুন সুর বাজানো হয়। এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় । এরপর গ্রামের বাড়ি ছয়চিড়ায় দ্বিতীয় জানাজা শেষে লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মরহুমের জানাজার নামাজে স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মো. আফজাল হোসেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ইকবাল, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম এল) এর সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাজিতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোর্শেদ জামান বিপিএম, বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
অধ্যাপক ইয়াকুব মিয়া একজন শিক্ষক থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসৈনিক, বিপ্লবী, জনপ্রতিনিধি এবং ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে জীবনের প্রতিটি ধাপ সাফল্যের সাথে অতিবাহিত করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।
তিনি গত শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৬ ঘটিকায় ভাগলপুর জহিরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়ে ছিলো ৮৫ বছর। তিনি ৫ কন্যা ও এক ছেলেসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
ব্যক্তিজীবনে তিনি স্থানীয় আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে বাজিতপুর ডিগ্রী কলেজে অধ্যাপক, রসায়নের শিক্ষক, ১৯৭১সালে মুক্তিযুদ্ধ, বামধারার বর্ষীয়ন রাজনীতিবিদ, বিপ্লবী, একাধিকবার কারাবরণ সর্বশেষ জনপ্রতিনিধি হিসেবে বাজিতপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান। রাজনৈতিকভাবে তিন প্রথমে ভাসানী ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। ১৯৬৮- ৬৯ সালের গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ শুরু করেন। তিনি বাজিতপুর- নিকলি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। তাঁর নেতৃত্বে বড় একটি মুক্তিবাহিনীর দল গড়ে উঠে। তাঁরা হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধ জীবন বাজি রেখে বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেন। যুদ্ধ শেষে তিনি আবার বাজিতপুর কলেজে শিক্ষকতায় ফিরে যান। ৭৩ সালে কলেজ থেকে ইয়াকুব আলীকে পিও ফিফটি (প্রেসিডেন্ট অর্ডার) আইনে পুলিশ গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ বাজিতপুর থানা ঘেরাও করে। পরে জনতার চোখ ফাঁকি দিয়ে তাঁকে কিশোরগঞ্জ কোর্টে চালান করে দেয়। খবর পেয়ে কয়েক হাজার মানুষ বাজিতপুর থেকে মিছিল করে কিশোরগঞ্জ কোর্ট ঘেরাও করে এবং মিছিল থেকে পুলিশ অনেক কর্মী সমর্থকে গ্রেফতার করে। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্তি পান। এর পর আর তিনি বাড়ি ফিরে যাননি। আত্মগোপনে চলেন যান, শুরু হয় বিপ্লবী জীবন। লড়াই করেন রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে। যোগ দেন সাম্যবাদী দলে। একপর্যায়ে আবার তিনি ৭৪ সালের স্পেশাল পাওয়ার এক্টে গ্রফতার হন। প্রায় পাঁচ বছর জেল খেটে মুক্তি পান।এর পর প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন। বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল ( এম এল) র নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে ভাটি অঞ্চলে সরকার বিরোধী সংগ্রাম পরিচিত হয়। তিনি বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৮৬ সালে প্রথম উপজেলা নির্বাচনে বিপুল ভোটে তিনি বাজিতপুর উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি প্রচুর বই পড়তেন। একসময় তিনি তাবলীগ জামাতের সাথে যুক্ত থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর জীবন যাপন করে গেছেন।