রাজশাহী প্রতিনিধি
সোমবার ফারাক্কা ব্যারেজের সবকটি জল কপাট খুলে দিলেও ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহীর পদ্মায় পানির উচ্চতার কোনো তারতম্য হয়নি। রাজশাহী নগরীর বড়কুটি পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানির বিপদসীমা ধরা হয় ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। সোমবার সন্ধ্যায় সেখানে পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ৩০ মিটার। এদিন সকাল ৬টায় ছিল ১৬ দশমিক ২৭ মিটার। ফলে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজশাহী পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপদসীমার ২ দশমিক ২০ মিটার নিচে ছিল।
মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) সকাল ৬টাতেও পানির উচ্চতা একই রয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজশাহীর নগরীর বড়কুঠি পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানির উচ্চতা পরিমাপকারী পাউবোর গেজ রিডার এনামুল হক।
উত্তরাঞ্চলীয় পানিবিজ্ঞান পরিমাপ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা সাধারণত ১০ দিনের জন্য নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিই। আগামী ১০ দিনের মধ্যেও পদ্মার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করবে না। তারপরেও নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না নদীতে পানি বাড়বে কিনা। রোববার দুপুর থেকেই পানি বাড়ছে। আরও ২-৩ দিন পার হলে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে।’
রাজশাহীতে নদী নিয়ে দীর্ঘ দিন গবেষণা করেন গবেষক মাহাবুব সিদ্দিক। তিনি জানান, সম্প্রতি ফেনী ও কুমিল্লার বন্যায় অনেকে ফারাক্কার খোলার খবরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু এতে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। দুটি স্থানের প্রেক্ষাপট একেবারে ভিন্ন। গঙ্গার পানি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বরাবরই বছরের এই সময়টাতে ভারত ফারাক্কার জল কপাটগুলো ছেড়ে রাখে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বরং আমাদের সচেতনতা ও প্রস্তুতি বাড়ানো উচিৎ এ অঞ্চলের খাল বিল শাখা নদীগুলো নাব্যতা ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে। তিনি বলেন উজানে পানির ঢল বৃদ্ধি না পেলে পদ্মায় বন্যা হয় না। রাজশাহীর পদ্মা ২৬ লাখ ৯০ হাজার কিউসেক পানি ধারণ করতে পারে। বর্তমানে নদী দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ১৪ লাখ কিউসেক পানি।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান জানান, পাবনার পাকশীতে বিপদসীমা ২২ দশমিক ৫০ মিটার। এখানে সোমবার সন্ধ্যায় পানির উচ্চতা পাওয়া ২০ দশমিক ৪৮ মিটার। বিপদসীমার দুই মিটার নিচ দিয়ে পানি বয়ে যাচ্ছে। পদ্মার সরদহ পয়েন্টে বিপদসীমা ১৬ দশমিক ৯২ মিটার। সন্ধ্যায় সেখানে পানির উচ্চতা পাওয়া গেছে ১৫ দশমিক ৬ মিটার। তবে গত সাত দিনে পদ্মার শাখা ও উপশাখা নদীগুলোতে পানি কিছুটা বেড়েছে।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান অঙ্কুর বলেন, ‘সোমবার বিকেলে ফারাক্কা বাঁধের সব গেট খুলে দিয়েছে। তারা খুলে দেয়ার বিষয়টি আগেই জানিয়েছে বলে দাবি করেছে। যদিও আমরা আগে থেকে সবকিছুর প্রস্তুতি নিয়ে আছি। প্রতিবছর বাঁধ খুলে দেয়া হয়। তবে এবার আশঙ্কা করা হচ্ছে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এতে চরাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।’
এদিকে ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেবার ঘোষণায় ফেসবুকে অনেকেই আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনেকেই বলছেন পরিস্থিতি ফেনীর চেয়ে খারাপ হবে তাই সকলে প্রস্তুত হোন। এমন পোস্ট দেখে অনেকেই সকাল বেলা নদীর পানি দেখতে পদ্মা মুখি হয়েছেন। তবে পানি দেখে আশ্বস্ত হন যে ফারাক্কার সকল জল কপাট খুললেও তেমন একটা প্রভাব পড়েনি এখানে। বরং সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজশাহীর পঞ্চবটি নদীর পাড় এলাকায় নদীর পানি কিছুটা কমতে দেখা গেছে। এতে ঘোষণা ও বাস্তবতায় মিল খুঁজে পাচ্ছেন না দর্শনার্থীরা।
এদিকে, ফারাক্কা ব্যারেজের গেট খোলা নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেছেন, এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা, যা বর্ষা মৌসুমে করা হয়ে থাকে। সোমবার রাতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে এ কথা বলেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র।
অপরদিকে, ভারতের বিহার ও ঝাড়খণ্ডে বন্যার জেরে ফারাক্কা ব্যারেজের ১০৯টি গেট খুলে দিয়েছে ভারত। সোমবার ওই গেট খুলে দেয়া হয়। এতে একদিনে বাংলাদেশে ১১ লাখ কিউসেক পানি ঢোকার কথা জানানো হয়। বাঁধ খুলে দেয়ায় বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদসহ বাংলাদেশেও। বন্যা পরিস্থিতি ও পাহাড়ি ঢলের বিষয়ে আগে থেকে বাংলাদেশকে তথ্য দেয়া হচ্ছে বলে ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
সোমবার ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিবেশী দুই রাজ্যে বন্যার জেরে পানির চাপ পড়েছে। তবে স্বস্তির বিষয়, এখনও নেপাল থেকে পাহাড়ি ঢল নামেনি। ফারাক্কা ব্যারেজ এলাকায় পানি বিপদসীমার ৭৭ দশমিক ৩৪ মিটার ওপর দিয়ে বইতে থাকায় বাধ্য হয়ে গেট খুলতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ফিডার ক্যানেলেও পানির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ফারাক্কা ব্যারেজের আপ স্ট্রিমে পানি ধারণ ক্ষমতা ২৬ দশমিক ২৪ মিটার। বিপদসীমা ২২ দশমিক ২৫ মিটার এবং সর্তকতাসীমা ২১ দশমিক ২৫ মিটার। আপ স্ট্রিমের ধারণ ক্ষমতা অতিক্রম করায় শনিবার থেকে খুলে দেয়া হয় অধিকাংশ গেট। আর সোমবার সর্বোচ্চ ১০৯ গেট খুলে দেয়া হয়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধের অবস্থান। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে ১৯৬২ সালে এই বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই বাঁধের কাজ শেষ হয় ১৯৭০ সালে। ফারাক্কা বাঁধের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল।