আমার কাগজ প্রতিবেদক
ডলারের বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকর করা থেকে সরে আসছে ব্যাংকগুলো। ডলার-সংকটের কারণে কিছু ব্যাংক এখন ঘোষিত দরের চেয়ে পাঁচ-ছয় টাকা বেশি দামে প্রবাসী আয় কিনছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনানুষ্ঠানিক পরামর্শেই ব্যাংকগুলো ডলারের এই দাম দিচ্ছে। ফলে প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম বেড়ে হয়েছে ১১৫-১১৬ টাকা।
এতে এসব ব্যাংকের মাধ্যমে গত দুই সপ্তাহে আসা প্রবাসী আয়ে বড় প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। ব্যাংক খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর মাধ্যমে ডলারের দাম বাজারভিত্তিক হওয়ার পথে এগোচ্ছে। তবে এসব ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ভবিষ্যতে তারা আমদানি বিল পরিশোধেও ডলারের জন্য বেশি দাম রাখবে। এসব সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, এই ডলার আপাতত ভবিষ্যতের জন্য রাখছে ব্যাংকগুলো। কারণ, আমদানিতে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম এখনো ১১০ টাকা ৫০ পয়সা।
ব্যাংকগুলো যে বেশি দামে প্রবাসী আয় কিনছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংককেও তারা নিয়মিতভাবে অবহিত করে আসছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। পাশাপাশি ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে প্রবাসী আয় কেনার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে বিদেশের বিভিন্ন রেমিট্যান্স ও এক্সচেঞ্জ হাউস সূত্রেও। দেশের কমপক্ষে ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি ও প্রবাসী আয় বিভাগের কর্মকর্তা বেশি দামে রেমিট্যান্স কেনার বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন। তবে তাঁরা নাম প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয় দেশে এসেছে গত মাসে। সেপ্টেম্বরে বৈধ পথে দেশে প্রবাসী আয় আসে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। এর আগে সর্বশেষ ২০২০ সালের এপ্রিলে এত কম প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) বিভিন্ন সময়ে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছিল। তবে এখন সেই সিদ্ধান্তে কিছুটা ভাটা পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনানুষ্ঠানিক পদক্ষেপের ফলে ধীরে ধীরে বাজারভিত্তিক হচ্ছে ডলারের দাম। দুই প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ছিল, প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম হবে ১১০ টাকা, আর আমদানি বিল পরিশোধে হবে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে ব্যাংকগুলো ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে প্রবাসী আয় কিনলে সেটা খুবই দুঃখজনক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনানুষ্ঠানিক এমন কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। ডলারের দাম নিয়ে আতঙ্ক থাকলে তা পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে মার্জিন পদ্ধতি চালু করতে পারে। এতে ডলারের হঠাৎ দাম বৃদ্ধি রোধ করা যাবে। না হলে দাম একেবারে অনেক বেড়ে যেতে পারে, যার প্রভাব পড়বে খাদ্যপণ্যের ওপর। মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ডলারের বাজার নিয়ে ভালো ব্যবস্থাপনা করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। সময়মতো দাম বাজারভিত্তিক করা গেলে এই সংকট তৈরি হতো না।
গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয় দেশে এসেছে গত মাসে। সেপ্টেম্বরে বৈধ পথে দেশে প্রবাসী আয় আসে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। এর আগে সর্বশেষ ২০২০ সালের এপ্রিলে এত কম প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল। ওই মাসে প্রবাসী আয় এসেছিল ১০৯ কোটি ডলার। ডলার-সংকটের এ সময়ে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় ডলার-সংকট আরও প্রকট হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞদের প্রায় সবাই মতামত দেন যে ডলারের দাম বেঁধে রেখে প্রবাসী আয় বাড়ানো সম্ভব নয়, কারণ বেশি দাম পাওয়ার কারণে প্রবাসীদের অনেকেই আয় হুন্ডিতে পাঠাচ্ছেন। জানা গেছে, প্রবাসী আয় তলানিতে নামার পর ডলার-সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ব্যাংককে ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনার পরামর্শ দেয়। ফলে চলতি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহেই দেশে প্রবাসী আয় আসা বেশ অনেকটা বেড়েছে।
তবে বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্তে কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রবাসী আয়ের ডলারের দাম এখনো ১১০ টাকা। বেশি দামে কেউ কিনলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তাদের ধরার কথা।’
একাধিক ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি মাসের শুরুতে বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনানুষ্ঠানিকভাবে বলেছে, যে দামেই হোক, বেশি প্রবাসী আয় আনতে হবে। এরপর কোনো কোনো ব্যাংক ১১৫-১১৬ টাকা দামে প্রবাসী আয় এনেছে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, প্রতি ডলারে সর্বোচ্চ আড়াই টাকা বেশি দাম দেওয়া যাবে। ফলে এখন প্রায় এক ডজন ব্যাংক সেই দামে প্রবাসী আয় আনছে।
এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘মৌখিকভাবে ডলারের দাম বাড়ানোর কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি। আগের নির্ধারিত দামেই ডলার কেনা ও বিক্রি করা হচ্ছে।’
তবে বিভিন্ন ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বেশি দামে ডলার কিনতে এমন সব ব্যাংককে অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনা দিয়েছে, যাদের মাধ্যমে আগে থেকেই ভালো পরিমাণে প্রবাসী আয় দেশে আসছিল। কিন্তু পরে ডলারের দাম বেঁধে দিয়ে তা মানতে বাধ্য করার কারণে এসব ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসা কমে যায়। এসব ব্যাংকের মধ্যে শরিয়াহভিত্তিক পাশাপাশি প্রচলিত ধারার ভালো কয়েকটি ব্যাংকও রয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশি দামে ডলার কেনার জন্য ১০ ব্যাংকের কর্মকর্তাকে জরিমানা করেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের প্রথম ১৩ দিনে প্রবাসী আয় এসেছে ৭৮ কোটি ১২ লাখ ডলার। গত বছরের অক্টোবরের প্রথম ১১ দিনে প্রবাসী আয় এসেছিল ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। চলতি মাসে প্রবাসী আয় আসার যে ধারা, তা অব্যাহত থাকলে মাস শেষে তা ১৮০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
দেখা গেছে, যেসব ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ মেনে প্রবাসী আয় এনেছে, তাদের আয় হঠাৎ বেড়ে গেছে। আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে পুরো সেপ্টেম্বরে ৪ কোটি ৪ লাখ ডলার এলেও চলতি মাসের ১৩ দিনেই ব্যাংকটির মাধ্যমে এসেছে ৪ কোটি ৮২ লাখ ডলার। পূবালী ব্যাংক গত সেপ্টেম্বর মাসে ৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের আয় আনলেও চলতি মাসের প্রথম ১৩ দিনে এনেছে ৫ কোটি ২৬ লাখ ডলার। এভাবে বেশ কিছু ব্যাংকের প্রবাসী আয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
এসব ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রেমিট্যান্স হাউসগুলো থেকে বেশি দামে প্রবাসী আয় কিনতে হয়েছে। এ জন্য আয় বেড়েছে। নির্ধারিত দামে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। যেহেতু বেশি দামে কেনা শুরু হয়েছে, ফলে নির্ধারিত দাম আর কার্যকর থাকবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ সম্পর্কে নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন কোনো নির্দেশনার বিষয়ে আমার জানা নেই।’
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শ পাওয়া একটি ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে বেশি দামে প্রবাসী আয় কেনা হচ্ছে। আমদানিকারকের কাছে অবশ্য কত দামে ডলার বিক্রি করা হবে, তা এখনো নির্ধারণ হয়নি। ফলে আমরা একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। কারণ, ১১৫ টাকায় ডলার কিনে ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি করতে হলে বড় ধরনের লোকসানে পড়তে হবে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে ব্যাংকগুলো।