
আমার কাগজ ডেস্ক
শিক্ষা হলো সেতু, যা হৃদয়কে সংযুক্ত করে; বিনিময় হলো বন্ধন, যা বিশ্বকে উষ্ণতা দেয়। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী পরিচালিত শাহীন স্কুল এন্ড কলেজ, চট্টগ্রাম শাখার একটি প্রতিনিধিদল ২৩ সেপ্টেম্বর বেইজিং ইয়ুইং স্কুল পরিদর্শন করে এবং স্কুলটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে চমৎকার ও হৃদয়গ্রাহী কিছু কার্যক্রমে অংশ নেয়। শাহীন স্কুল এন্ড কলেজ, চট্টগ্রাম শাখার অধ্যক্ষ সালেহ আহমেদ খান প্রতিনিধিদলটির নেতৃত্ব দেন। ইয়ুইং স্কুল বেইজিংয়ের একটি প্রথিতযশা প্রতিষ্ঠান, যার ৭০ বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাস রয়েছে এবং যেটি অত্যাধুনিক শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনা ধারণায় সমৃদ্ধ।
স্বাগত অনুষ্ঠানে ইয়ুইং স্কুলের জুনিয়র মিডিল বিভাগের শিক্ষার্থী জাং সু ইয়ান বেইজিং অপেরা নৃত্য ‘হং ইউ তান শিন’ পরিবেশন করেন। বাংলাদেশী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও দৃষ্টিনন্দন নৃত্য ও সমবেত কণ্ঠে গান উপস্থাপন করেন।
বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের নাচ দেখে ইয়ুইং স্কুলের শিক্ষার্থী ছুই ওয়েন খুই বলেন, “তাদের নৃত্যে ঐতিহ্যবাহী সৌন্দর্য ছিল এবং আধুনিকতার সাথে মিলিয়ে উদ্ভাবনী শৈলী দেখানো হয়েছে। তারা নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে সংগীত ও নৃত্যের নিপূণ সমন্বয় ঘটিয়েছে।”
বাংলাদেশের শিক্ষার্থী নাহিন তাজরীন উল্লাহ বলেন, “আমি খুবই আনন্দিত। চীনের শিক্ষক ও সহপাঠীদের সাথে চীনা সংস্কৃতি অনুভব করতে পেরে আমার মনে হয়েছে যেন বাংলাদেশেই আছি। মনে হয়েছে পরিবারের সাথেই আছি, মুহূর্তের মধ্যেই সকলে বন্ধু হয়ে গেছি। অনুভূতিটি সত্যি খুবই চমত্কার!”
বাংলাদেশী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ইয়ুইং স্কুলের ক্যাম্পাস পরিদর্শন করেন। ইয়ুইং স্কুলকে ‘বেইজিংয়ের সবচেয়ে সুন্দর ক্যাম্পাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ক্যাম্পাসে রয়েছে ৫টি বাগান ও ৭টি চত্বর। এ ছাড়াও ক্যাম্পাসে রয়েছে স্কুল-ফার্ম, জীববিজ্ঞান সম্প্রসারণ ভিত্তি ও একটি ছোট চিড়িয়াখানা, যা শিক্ষার্থীদের প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে জীবনের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে সহায়তা করে। বইয়ে সজ্জিত করিডোর ও পূর্বসূরী দার্শনিকদের উক্তি খোদাইকৃত ‘ওয়েনতাও লু’ (সত্য জিজ্ঞাসার পথ) ক্যাম্পাসে একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের শিক্ষক সানজিদা আক্তার বলেন, “আমাদের জন্য বিশেষ সৌভাগ্যের বিষয় যে, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং যেই বেইজিং ইয়ুইং স্কুল পরিদর্শন করেছেন, আমরা সেখানে যেতে পেরেছি। এখানের ক্যাম্পাস খুব বড় এবং ব্যবস্থা খুব উন্নত। আমরা স্কুলের কিছু প্রোগ্রাম দেখেছি এবং কিছু প্রোগ্রামে আমরা নিজেরাই অংশগ্রহণ করতে পেরেছি। এখানকার শিক্ষার মিথস্ক্রিয়া-ভিত্তিক ব্যবস্থা আমাদের খুব অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা সেই অনুপ্রেরণা নিয়ে আমাদের নিজেদের বিদ্যালয়ে বাস্তবায়নের চেষ্টা করবো আশা করি। সব কিছু আমার খুবই ভাল লেগেছে।”
ইয়ুইং স্কুলের চীনা ভাষার শিক্ষিকা ফান আয়ুয়ান বলেন, “এই কার্যক্রমের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ ও তার সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানতে পেরেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনিময় খুবই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছে, যা খুবই উষ্ণ অনুভূতির সৃষ্টি করেছে। এই বন্ধুত্ব শুধুমাত্র দেশগুলোর মধ্যকার বন্ধুত্বই নয়, এটি স্কুলগুলোর মধ্যকারও বন্ধুত্ব, এবং আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যকার বন্ধুত্ব।”
বাংলাদেশী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চীনের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক ক্লাসও উপভোগ করেন। তারা চীনা ক্যালিগ্রাফি অনুশীলন করেন, পাখায় ‘福’ (সৌভাগ্য) অক্ষর লেখেন এবং ঐতিহ্যবাহী চীনা গিঁট (চাইনিজ নট) বুননের শিল্পও শেখেন।
ইয়ুইং স্কুলের শিক্ষার্থী নিউ ইউচেন বলেন, “আমরা যদিও ভিন্ন ভিন্ন দেশে বাস করি এবং ভাষাও আলাদা, তবুও আমরা একে অপরের হাসি বুঝতে পারি। জীবনের প্রতি আমাদের ভালবাসা এবং বন্ধুত্বের আকাঙ্ক্ষা পুরোপুরি একই।”
বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ওয়াশিউর রহমান বলেন, “এই স্কুল পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা খুব আনন্দপূর্ণ। স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করে আমি বুঝতে পারছি যে তারা খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ, তাদের সাথে কথা বলে মনে হয় যে, আমি নিজের দেশের মানুষের সাথে কথা বলছি, অনেকের বন্ধু হয়েছি। এখানকার পরিবেশ খুবই সুন্দর। এসব স্মৃতি আমাদের কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে, কারণ আমরা এ বয়সে এমন একটি স্কুলে আসতে পেরেছি। এটি সত্যি আমাদের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার।”
বাংলাদেশের শিক্ষক কাজী মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম বলেন, “বর্তমানে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। চীনের সাথে আমাদের শুধু কূটনৈতিক সম্পর্ক নয়, আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রে একটা মিল রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও চীন পাশে দাঁড়ায় সবসময়। চীনের সাথে বাংলাদেশের যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে সেটা অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং ভবিষ্যতে তা আরো ত্বরান্বিত হবে আশা করি।”
চলতি বছর হচ্ছে চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকী এবং চীন-বাংলাদেশ জনবিনিময় বর্ষ। উভয়পক্ষই এই বিনিময় কার্যক্রম নিয়ে অত্যন্ত সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন এবং ভবিষ্যত সহযোগিতার প্রতি উচ্চ প্রত্যাশা পোষণ করেন।
ইয়ুইং স্কুলের শিক্ষার্থী ওয়াং আইমির বলেন, “আমি আশা করি চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হবে। আমরা একে অপরের কাছ থেকে ভাল দিকগুলো শিখব, একে অপরের গুণাবলী বুঝতে পারব এবং আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে একে অপরের অনন্য সংস্কৃতি অধ্যয়ন করব। আমি এই ধরনের বিনিময় কার্যক্রম বেশি করে আয়োজন করা হবে বলে প্রত্যাশা রাখি, যাতে দু’দেশের মানুষ একে অপরকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারে এবং স্বাভাবিকভাবেই একে অপরকে পছন্দও করবে।”
শাহীন স্কুল এন্ড কলেজ চট্টগ্রাম শাখার অধ্যক্ষ সালেহ আহমেদ খান বলেন, “এবারের সফর একটি সেতুবন্ধন। গত ৫০ বছরে চীন সরকারের সাহায্যে বাংলাদেশে অনেক সেতু বানানো হয়েছে, কনক্রিট ও স্টিল দিয়ে। এবারের সফরের মাধ্যমে আমরা অন্য ধরনের সেতু বানাতে চাই, সেটি হল বন্ধুত্বের সেতু। সেই সেতুতে স্টিল থাকবে না, থাকবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, ভালবাসা, পারস্পরিক বিনিময়, শিক্ষাগত, প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক বিনিময়। এ দিক থেকে বিবেচনায় আমাদের এবারের সফরটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সফর। আমরা আশা করছি, চীনের শিক্ষার্থীদেরকেও আমরা বাংলাদেশে সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানাবো, তারা বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং লেখাপড়া সংক্রান্ত বিষয়ে পরিচিত হতে পারবে, তখন আমাদের এ সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে এবং এ ব্যাপারে আমি খুব আশাবাদী।”
ইয়ুইং স্কুলের অধ্যক্ষ চাও চিয়া বলেন, “আজকের এই বিনিময়ের ফলাফল খুবই চমত্কার হয়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি বেইজিং অপেরা বাংলাদেশী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করেছে, বাংলাদেশী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও তাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও শিল্প আমাদের দেখিয়েছেন। আমাদের মধ্যে একটি আরও গভীর সমন্বিত বিনিময়ের প্রক্রিয়া হয়েছে। আগামী দিনগুলোতে আমরা দুই দেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী, আমাদের সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, স্কুলের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাংলাদেশের শাহীন স্কুল এন্ড কলেজের সাথে আরও যোগাযোগ করব, এবং তাদের উত্কর্ষের দিকগুলো আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জানার ও শেখার সুযোগ দেব, পারস্পরিক বিনিময় ও পরিদর্শনের মাধ্যমে।”
এই পরিদর্শন কেবল একটি সাংস্কৃতিক বিনিময়ই নয়, এটি ছিল হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের সংলাপ, যা নিঃসন্দেহে দুই দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে ভবিষ্যত সহযোগিতার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে!
সূত্র:স্বর্ণা-হাশিম-লিলি,চায়না মিডিয়া গ্রুপ।