সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
ভারতের পাহাড়ি ঢল আর অতিবৃষ্টির পানিতে সুনামগঞ্জের সবকয়টি নদ-নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রধান নদী সুরমার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছে। রোববার (২ জুলাই) বিকেল ৩টায় সুনামগঞ্জ মিটার রিডিং স্টেশনে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার এবং ছাতকে ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছিল।
জেলার ১২ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ায় ডুবে গেছে সড়ক- রাস্তাঘাট। অনেক জায়গায় পানির স্রোতে সড়ক ভেঙে গেছে। এতে করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন হাওরের লক্ষাধিক মানুষ। অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার বসত ঘরে পানি ঢুকে পড়ায় বাধ্য হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে শুরু করেছেন অনেকে।
রোববার বিকেলে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ ঘুরে দেখা যায় হাঁস-মুরগি, গবাদি পশু নিয়ে একে একে মানুষ আসতে শুরু করেছেন। বাচ্চাসহ পরিবার -পরিজন নিয়ে সরকারি কলেজের তিনটি কক্ষে বেশ কয়েকটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় ভোর থেকে তাদের ঘরে পানি ঢুকতে শুরু করে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি বেড়ে বসত ঘরে থাকার মতো অবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়েই মাথা গোজার ঠাঁই পেতে এসেছেন কলেজে। তাদের মতো আরও অনেক পরিবার কলেজে এসে আশ্রয় নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানান তারা।
আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার নতুন হাছননগরের নার্গিস বেগম বলেন, ঘরে কোমড় পানি উঠে গেছে। বাচ্চা-কাচ্চা সামলানো খুব কঠিন হয়ে গেছে। তাই মা-বাবা, ভাই-বোন নিয়ে কলেজে এসেছি। ঘরে পানি উঠে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। এতক্ষণে নিশ্চিত ঘরে বুক সমান পানি উঠে গেছে।
সুলতানপুরে ময়না বেগম বলেন, রাত্রেও ভালো ছিলাম। সকালে উঠে রান্না বসাইছি। রান্না হওয়ার আগেই ঘরে পানি চলে আসছে। হাটু সমান পানি রেখে আসছি ঘরে। আমরা এলাকার ২০-২৫টি ঘরের একই অবস্থা।
শামিম বলেন, ঘরে এখন আর ঠাঁই হয় না। বউ বাচ্চা নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি। জান বাঁচাতে গিয়ে বাধ্য হয়ে কলেজে এসে উঠেছি।
এদিকে দ্রুত পানি বৃদ্ধি দেখে আকস্মিক বন্যা মোকাবেলায় জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে বেলা ১২টায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন দপ্তর প্রধান ও সাংবাদিকদের নিয়ে তাৎক্ষণিক জরুরি সভা করেন জেলা প্রশাসন। সভায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে সে সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দেন জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী।
তিনি জানান, যেভাবে পানি বাড়ছে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি একটা বন্যার পূর্বাভাস আছে এমন অবস্থায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সম্মিলিতভাবে আমরা কিভাবে সেটি মোকাবেলা করব তার প্রস্তুতি নিতে তাৎক্ষণিকভাবে জরুরি সভার আহ্বান করি। আমাদের অতীতে বড় ধরনের একটা বন্যা মোকাবেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার আলোকে এ বছর আমাদের প্রস্তুতি অনেক। তাই আশা করি এ বছর আমাদের কম সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। ইতোমধ্যে নিম্নাঞ্চলের যারা বসতঘরে পানি ঢুকে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন তাদের ত্রানের আওতায় আনা হবে।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, যদি আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তার জন্য আমাদের কয়েক শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। উদ্ধার তৎপরতা চালানোর জন্য পুলিশ, বিজিবি, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরের সচল নৌকা ও স্পিডবোট প্রস্তুত রাখা আছে। প্রত্যেক উপজেলায় চাল পাঠানো হয়েছে। নগদ টাকা ও শুকনো খাবার মজুদ আছে। পানি বৃদ্ধির কারণে যদি বিদ্যুৎ বন্ধ হয় তার জন্য জেনারেটর রাখা হয়েছে। মোবাইল যোগাযোগ যেন বিচ্ছিন্ন না হয় সেজন্য মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোকে বিশেষ ব্যবস্থা রাখার জন্য বলা হয়েছে। এরপরও যদি মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায় তাহলে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের যোগাযোগ অব্যাহত রাখার জন্য স্যাটেলাইট ব্যবহারের মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
জরুরি সভায় আরও বক্তব্য রাখেন পৌর মেয়র নাদের বখত, ২৮ বিজিবি পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মাহবুবুর রহমান, পুলিশ সুপার মো. এহসান শাহ, স্থানীয় সরকার পরিচালক জাকির হোসেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার, জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ রজত কান্তি সোমসহ অন্যান্য দপ্তর প্রধান ও গণমাধ্যম নেতারা।