
বিশেষ প্রতিবেদক
বাংলায় প্রচলিত একটি প্রবাদ “যত দোষ নন্দ ঘোষ”। সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপে সেই প্রবাদের বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে। এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপারসহ চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী এবং রাতের পালায় ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহসিনা আরিফকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে হামিদের বিরুদ্ধে কিশোরগঞ্জের সদর থানায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আজহারুল ইসলাম এবং পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) টিএসআই মো. সোলায়মানকে। তাছাড়া এ ঘটনা তদন্তে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজি (প্রশাসন) মো. মতিউর রহমান শেখকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তরের এক বার্তায় এসব তথ্য জানানোর পর রাতে এ বিষয়ে অফিস আদেশ দেওয়া হয়েছে।
সরকার গৃহীত এ পদক্ষেপ সঙ্গত কারণে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। কেননা, যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তাদের দোষ কতটুকু তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের দুই ভাগে বিভক্ত করে পর্যালোচনার প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টদের মতামত। তাদের মতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে মামলার হিড়িক পড়ে। এসব মামলা নিয়ে বাণিজ্য এবং এর জের ধরে সৃষ্ট সমালোচনার বিষয়টি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রেখেছে। যে কারণে ঢালাও মামলায় গ্রেপ্তারের ব্যাপারে পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য অধঃস্তনদের নির্দেশনা দেয়া আছে। এ অবস্থায় সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে গত ১৪ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের সদর থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলার অভিযোগে দায়েরকৃত এই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের আরও অনেককে আসামি করা হয়। তবে অন্যান্য মামলার মতো এটির তদন্তও চলছিল ঢিমেতালে। এ কারণে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ হয়তো কিছুটা ধোপে টিকে।
কিন্তু বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগের যে দুই কর্মকর্তা বলির পাঁঠা হলেন, তারা কতটুকু দায়ী তা নিয়ে চলছে সমালোচনার ঝড়। পর্যবেক্ষকদের মতে, পুরো বিষয়টি ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে’ দেয়ার শামিল। ঘটনার পূর্বাপর পর্যালোচনায় এ মতের প্রমাণ মিলে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুপিসারে নয়, বিমানবন্দরে সব গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের উপস্থিতি এবং ইমিগ্রেশনের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই দেশ ছাড়েন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। শুধু নিজে নয়, সঙ্গে নিয়ে গেছেন ছেলে ও শ্যালককেও। ঢাকা ত্যাগের সময় সাবেক এ রাষ্ট্রপতি ভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহার করেন এবং বিমানবন্দরের সার্বিক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে তিনি প্রায় ৪ ঘণ্টা অবস্থান করেন। সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ের সম্মতি ছাড়া তিনি দেশত্যাগ করেননি।
জানা গেছে সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বুধবার রাত ১১টার দিকে বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালে পৌঁছার পর থেকে দেশত্যাগ পর্যন্ত কোনো কর্মকর্তা কী করেছেন কে কার সঙ্গে যোগাযোগ করে ইমিগ্রেশন সম্পন্নের নির্দেশ দিয়েছেন এ বিষয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। গোপনীয় প্রতিবেদনটি সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। এতে দেখা গেছে তিনটি সংস্থার কর্মকর্তারা আবদুল হামিদের দেশ ছাড়ার বিষয়টি জানতেন। তারা এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ঊর্ধ্বতনদের সম্মতি সাপেক্ষে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, টিজি বিমানযোগে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ব্যাংককগামী যাত্রী আবদুল হামিদ ভিআইপি টার্মিনালে আসলে, টার্মিনাল ইনচার্জ ওসি ইমিগ্রেশনকে বিষয়টি জানান। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি অবহিত করেন। পরে দুই সংস্থা থেকেই এ বিষয়ে অনাপত্তি দেন। সুইডেন-ভিত্তিক অনুসন্ধানী এবং জনস্বার্থবিষয়ক সংবাদমাধ্যম ‘নেত্র নিউজ’ শুক্রবার (৯ মে) এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে ইমিগ্রেশন (অভিবাসন) পুলিশের করা একটি সাধারণ ডায়েরির (জিডি) উদ্ধৃতি দেয়া হয়। লিখিত ওই নথি অনুযায়ী, হামিদ ও তার দুই আত্মীয়ের বিদেশ যাত্রার আগে সহকারি পরিচালক পদমর্যাদার একজন এনএসআই কর্মকর্তা ও ডিজিএফআইতে কর্মরত একজন উইং কমান্ডার অনাপত্তি প্রদান করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমান বন্দরে নিযুক্ত একজন সরকারি কর্মকর্তা নেত্র নিউজকে বলেন, “চিকিৎসার জন্য ব্যাংককগামী যাত্রী হিসেবে আবদুল হামিদ বুধবার (৭ মে) দিবাগত রাত দেড়টার দিকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন।”
“আওয়ামী লীগের এই নেতার সম্পর্কে ইমিগ্রেশন ডাটাবেইজে কোনো বিরূপ তথ্যও ছিল না। তবু তাৎক্ষণিকভাবে এনএসআই ও ডিজেএফআই কর্মকর্তাদের খবরটি জানায় ইমিগ্রেশন পুলিশ,” যোগ করেন তিনি।
অনুরোধের প্রেক্ষিতে দুইজন ডিজিএফআই ও এনএসআই কর্মকর্তা অনাপত্তি প্রদান করেন। তাদের অনাপত্তির বিবরণ লিপিবদ্ধ করা ছিল ওই সরকারি নথিতে।
সরকারি নথিতে আরও বলা হয়, এনএসআই ও ডিজিএফআই থেকে প্রাপ্ত অনাপত্তির বিষয়ে অভিবাসন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি ইমিগ্রেশন) তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান।
এরপর ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশের প্রেক্ষিতে আব্দুল হামিদ, তার পুত্র রিয়াদ আহমেদ ও তার শ্যালক এএনএম নওশাদ খানের অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।
কিন্তু দুইটি গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততা থাকা সত্তে¡ও, এখন পর্যন্ত যাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তারা সবাই মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। তবে অন্যান্য কিছু প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতার মতোই তাকে গ্রেপ্তার করা থেকে বিরত থাকে সরকার।
এবার তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশ ছেড়ে যেতে দেয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে জুলাই-আগস্ট বিক্ষোভে অংশ নেয়া ছাত্রদের কয়েকটি সংগঠন।
এর আগে আরও কিছু আওয়ামী লীগ নেতা দেশ ছাড়তে সক্ষম হন। এ নিয়ে অনেক দিন ধরেই ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন ওই সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। এবার তাদের কড়া প্রতিক্রিয়ার মুখে তৎপর হয়ে উঠে সরকার।