স্পোর্টস ডেস্ক
টেস্ট ক্রিকেটে সে এক প্রাগৈতিহাসিক সময়। নির্ধারিত সময় বাঁধা ছিল না, দিনের পর দিন খেলা চলত। তেমনই এক সময়ে ১৯৩৪ সালে ইংল্যান্ডকে ৫৬২ রানে হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। এরপর টেস্টের দৈর্ঘ্য চার দিনে নামল, এক দিন বিরতিসহ আবার বেড়ে ছয় দিন হলো; বিরতি বাদ দিয়ে টানা পাঁচ দিন হলো। তারপরও আর এত বড় রানের জয় দেখেনি ক্রিকেট, ভাবেওনি কেউ এমনটা হতে পারে। গতকাল মিরপুরে আফগানিস্তানকে ৫৪৬ রানে হারিয়ে বাংলাদেশ শুধু নিজেদের ইতিহাসই সমৃদ্ধ করেনি, দেড়শ বছরের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে রানের দিক থেকে তৃতীয় এবং আধুনিক টেস্ট যুগে (১৯৮০ সালে শুরু হওয়া পাঁচ দিনের টেস্ট) সর্বোচ্চ রানের জয়ে রেকর্ড গড়ার ইতিহাস গড়েছেন লিটনরা।
বাংলাদেশ দলের এই জয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানজুড়ে বিয়েবাড়ির হৈ-হুল্লোড়। এর মধ্যেই ব্যক্তিগত ও দলগত পুরস্কার তুলে দেওয়া হয় বিজয়ীদের হাতে। আনুষ্ঠানিক পুরস্কার বিতরণ শেষ হওয়ার পরও রেশ থেকে যায় অনেকক্ষণ। ক্রিকেটারদের অনেকেই মিডিয়াতে আলাদা সাক্ষাৎকার দেন। খেলোয়াড়, কোচিং স্টাফ এবং জাতীয় দল নির্বাচক প্যানেলের সদস্যরা অভিনন্দনে সিক্ত হন। বিধিনিষেধহীন সুখী পরিবারের ছবি আঁকা হয় খেলা শেষের ওই বিশেষ মুহূর্তে। রেকর্ড গড়া ৫৪৬ রানে টেস্ট জেতার পর একটু-আধটু উচ্ছ্বাস ও উল্লাস প্রকাশ করা বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে না এবং ক্রিকেটাররা খুশির আতিশয্যায় ভেসে যাননি। বরং পরিমিত ও পেশাদারিত্ব রেখে অর্জন আর সম্ভাবনার দিকগুলো সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন অধিনায়ক লিটন কুমার দাস।
টেস্ট পরিবারের নতুন সদস্য আফগানিস্তানের ব্যাটিং-বোলিং বিশ্বমানের হবে, তা কেউ আশা করেনি। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে গত চার দিন তেমন কিছু দেখাতেও পারেনি তারা। তবে বাংলাদেশ দলকে একবার অলআউট করতে পারাও অর্জনের দিক থেকে কিছু কম নয়। তাই আফগানদের দুর্বল দলের তকমা দিয়ে যে বা যাঁরা লিটনদের বিশাল অর্জনকে ছোট করে দেখার চেষ্টা করছেন, খেলোয়াড়দের কাছে তা ভালো লাগার কথা নয়। কারণ, এ রকম পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে একটা সময়ে তো যেতে হয়েছে টাইগারদের। বিষাদের গলি-ঘুপচি পেরিয়েই আজকের জায়গায় উন্নীত হতে পেরেছে বাংলাদেশ। তাই টেস্ট জয়ের পর এই যে আনন্দঘন মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দি করা এবং একে অন্যকে বুকে টেনে নেওয়া বিজয়ী খেলোয়াড়দের ন্যায্য উদযাপন। ১৪৬ বছরের টেস্ট ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান ব্যবধানে জয়ের রেকর্ড এটি। বিশ্বরেকর্ডটি ইংল্যান্ডের দখলে, ১৯২৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৬৭৫ রানের ব্যবধানে জিতেছিল তারা। এর ছয় বছর পর ১৯৩৪ সালে অস্ট্রেলিয়া ৫৬২ রানে হারায় ইংল্যান্ডকে। যদিও তখন বিরতি দিয়ে খেলা হতো টেস্ট ম্যাচ। পাঁচ দিন খেলা, চার দিন বিরতিতে ৯ দিন মাঠে থাকত ম্যাচ। টানা পাঁচ দিন খেলার নিয়ম চালু হওয়ার পর থেকে রেকর্ড ধরা হলে ৫৪৬ রানের জয় বিশ্বরেকর্ড।
২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৩৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ জিতেছে ১৮টি। জয়ের ম্যাচগুলোতে সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী পারফরম্যান্স দেখা গেল ২৩ বছর পর। নিউজিল্যান্ড বা ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ একই ছন্দে খেলবে– সে আশা করা যায় না। উন্নতির ধারাবাহিকতা থাকলেই খুশি হবেন সমর্থকরা। আবার অপেক্ষাকৃত কম শক্তির দলের বিপক্ষে সুযোগ পেলে একপেশে ক্রিকেট খেলবে, সে প্রত্যাশাও বাড়িয়ে দিল আফগানিস্তানের বিপক্ষে করা পারফরম্যান্স। লিটনরা প্রথম থেকেই দাপুটে ক্রিকেট খেলে চালকের আসনে ছিলেন। টপঅর্ডার ব্যাটাররা দারুণ ক্রিকেট খেলেছেন। জাকির হাসান, মাহমুদুল হাসান জয়, নাজমুল হোসেন শান্ত, মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম, লিটন কুমার দাস, মেহেদী হাসান মিরাজ– এ সাত ব্যাটার কমবেশি অবদান রেখেছেন বিশাল স্কোর গড়ে। জোড়া সেঞ্চুরি করে সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন শান্ত। মুমিনুলের সেঞ্চুরিটিও বড় লিড পেতে সাহায্য করেছে। ব্যাটিংয়ের মতো বোলিং ইউনিটও ছিল দুর্বার। স্পোর্টিং উইকেটে খেলা হওয়ায় ২০ উইকেটের ১৪টিই শিকার তিন পেসারের। এবাদত হোসেন, তাসকিন আহমেদের কিছু ডেলিভারি ছিল রোমাঞ্চ ছড়ানো। হাসমতউল্লাহ শহীদি, জহির খানকে বলের আঘাতে ম্যাচ থেকে ছিটকে দেওয়া উত্তেজনার পারদ তোলা দুটি মুহূর্ত। এককথায় টেস্ট জয়ে পেসারদের ভূমিকা ছিল মনে রাখার মতো। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে পেসারদের সেরা পারফরম্যান্স এটি। মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়ের টেস্টেও ১৩ উইকেট শিকার করেছিলেন পেসাররা। সেখানে আফগানিস্তানের বিপক্ষে দেশের কন্ডিশনে পেলেন ১৪ উইকেট। এ থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার, অনুকূল কন্ডিশন দেওয়া হলে দেশের মাটিতেও যে কোনো দলকে দুবার অলআউট করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন তাসকিনরা।
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ২৩৬ রানের লিডের সঙ্গে দ্বিতীয় ইনিংসের ৪২৫ রান (৪ উইকেটে) বিশাল লক্ষ্যের সামনে দাঁড় করায় আফগানিস্তানকে। নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে ৬৬২ রানের লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া ছিল রেকর্ড। যেটা তাড়া করতে নেমে আফগানরা অলআউট হয় ১১৫ রানে। দুই উইকেট হারিয়ে ৪৫ রানে তৃতীয় দিন শেষ করে সফরকারীরা। গতকাল ২ ঘণ্টা ১২ মিনিটে তাদের ইনিংস গুটিয়ে দেয় স্বাগতিকরা। সম্ভাবনা জাগালেও শেষ পর্যন্ত পাঁচ উইকেট পাওয়া হলো না তাসকিনের। ৩৩তম ওভারের তিন ও চার নম্বর বলে জহিরকে দুবার আউট করলেও রিভিউতে বেঁচে যান তিনি। প্রথমবার পাঁচ উইকেট পাওয়ার খুশিতে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতাসূচক সিজদা থেকে উঠে ডানহাতি এ পেসার দেখেন আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে ক্যাচ বাতিল। পরের আউটে জহির ড্রেসিংরুমে ফেরার পথ ধরলেও নো বল ডেকে আউট বাতিল করা হয়। এর পরই জহিরকে মাঠ ছাড়তে হয় হাতে বলের আঘাত নিয়ে। তাঁর রিটায়ার্ড হার্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে ম্যাচের সমাপ্তি ঘটে। যে ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় নাজমুল হোসেন শান্ত।