
আমার কাগজ প্রতিবেদক
শনিবার ছুটির বিকেলে পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, প্রবেশ ফটকের সামনেই একসারি ভ্রাম্যমাণ দোকান। কেউ বসেছেন আলু, পেয়াঁজ নিয়ে। কারো দোকানে ফল, কেউ বিক্রি করছেন ডাব।
গেইটের সামনেই ভ্যানে করে পেঁয়াজ বিক্রি করছিলেন আব্দুস সেলিম নামের এক বিক্রেতা। ভেতরে কী হয় জানতে চাইলে বললেন, “ইসলামিক অনুষ্ঠান হইতেছে।”
ফটকের উপরে তাকাতেই দেখা গেল প্যানাফ্লেক্সের বড় ব্যানার ঝুলছে। তাতে লেখা– ‘ইসলামিক স্টাডি সেমিনার’। আয়োজক আল-ঈমান ফাউন্ডেশন।
বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র জহির রায়হানের নামে এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্বোধন করা হয় ২০০৮ সালের ২২ মার্চ। এক বছর পর ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠানের জন্য মিলনায়তন ভাড়া দেওয়া শুরু হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে থাকা ৪০৮ আসনের এই মিলনায়তনের সঙ্গে মহড়া কক্ষ আছে। আর আছে একটি পাঠাগার, যদিও সেটা নামেমাত্র।
প্রায় দেড় যুগ আগে উদ্বোধন হলেও এ কেন্দ্র সংস্কৃতি চর্চায় তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। বেশিরভাগ সময় এর দরজা বন্ধ থাকে।
গত ছয় মাসে এখানে মাত্র ১৮ দিন নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, তাও মূলধারার কোনো প্রযোজনা নয়। অথচ ২০০৮ সালে এক জমকালো নাট্যোৎসবের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। তখন নাট্যকর্মীরা নিয়মিত নাটক মঞ্চায়নের ঘোষণা দিয়েছিলেন; বাস্তবে সেই অঙ্গীকার পূরণ হয়নি।
এখন এখানে কিছু যাত্রাধর্মী নাটক হয় বটে, কিন্তু সংগীত বা নৃত্যের মত অন্য সাংস্কৃতিক আয়োজন নেই। এমনকি ১৯ অগাস্ট জহির রায়হানের জন্মদিনেও তাকে স্মরণের কোনো উদ্যোগ রাখা হয়নি।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক অমরেশ মণ্ডল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, বিগত বছরগুলোতেও জহির রায়হানের জন্মদিন কিংবা মৃত্যুদিনে এখানে কোনো আয়োজন ছিল না।
রাজধানীর নাট্যদলগুলো যেখানে মিলনায়তনের অভাবে নাটক মঞ্চায়ন করতে না পারার অভিযোগ জানাচ্ছে, সেখানে শহরের পুরোনো অংশেই একটি মিলনায়তন নাটক ও সাংস্কৃতিক আয়োজনের অভাবে ধুঁকছে।
সংস্কৃতিকর্মীদের বললেন, এ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে সচল করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি প্রণোদনার প্রয়োজন। সেইসঙ্গে স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করাও জরুরি।
সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটিতে অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সদস্যভুক্ত নাট্যদল এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটকে ভাড়া দিতে হয় ৭ হাজার টাকা, সঙ্গে ১০৫০ টাকার ভ্যাট।
অন্যান্য অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে শুক্রবার ছাড়া ভাড়া ৮ হাজার টাকা এবং ১২০০ টাকা ভ্যাট দিতে হয়। শুক্রবার প্রতি বেলার ভাড়া ১২ হাজার টাকা, সঙ্গে ভ্যাট প্রযোজ্য।
এখন কী হচ্ছে
শনিবার বিকেলে লোহারপুল সড়কের জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে প্রবেশ করে দেখা গেল নিচতলায় প্রায় পুরোটাজুড়ে মোটর সাইকেল রাখা। শেষ মাথায় ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের কার্যালয়।
জহির রায়হানের যে প্রতিকৃতিটি রয়েছে; তার সামনেই রাখা আছে কয়েকটি মোটর সাইকেল।
স্থানীয় কয়েকজন বললেন, ভেতরে কাউন্সিলরের কার্যালয় থাকায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বাইরেও প্রচুর লোকজনের আনাগোনা আছে এখানে। তবে কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সামনে গিয়ে সেটি বন্ধ পাওয়া গেল।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় মিলনায়তনে প্রবেশ করে দেখা গেল, ‘আল-ঈমান ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে ‘ইসলামিক স্টাডি’ সেমিনার চলছে।
সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক অমরেশ মণ্ডল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “এখানে নিয়মিত অনুষ্ঠান হয় না। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সদস্যভুক্ত দলগুলো তো শো করতে আসে না। অন্য অনুষ্ঠানও খুব কম হয়।”
গত জানুয়ারি থেকে চলতি অগাস্ট পর্যন্ত এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে অনুষ্ঠানের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জানুয়ারিতে চারটি, ফেব্রুয়ারিতে চারটি নাটকের প্রদর্শনী হয়েছে।
মার্চ মাসে রোজা থাকায় কোনো নাটকের প্রদর্শনী হয়নি; পুরো মাসই বন্ধ ছিল সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি। এপ্রিলে দুটি এবং মে মাসে চারটি নাটকের প্রদর্শনী হয়।
জুন মাসে কোনো নাটকের প্রদর্শনী হয়নি। জুলাই মাসে তিনটি এবং ১৬ অগাস্ট পর্যন্ত দুটি নাটকের প্রদর্শনী হয়েছে।
তবে এসব নাটকের কোনোটিই গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনভুক্ত কোনো দলের প্রযোজনা নয়।
সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নিচতলার পাঠাগারটি বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক বললেন, পাঠকও আসে না।
“বইয়ের সংখ্যা খুব বেশি না। তিন শতাধিক হবে। আর নিয়মিত পত্রিকাও রাখতে পারছি না। পত্রিকা রাখা হলে কিছু পাঠক হয়ত আসবে।”
সংকট কোথায়?
জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে নাটক মঞ্চায়নের অভিজ্ঞতা আছে বিক্রমপুর শিল্পী গোষ্ঠীর। দলটি এই মিলনায়তনে ‘ঝরাপাতা’ ও ‘গাঁয়ের ছেলে রমজান’ নামে দুটি নাটক মঞ্চস্থ করেছে। আগামী অক্টোবরে ‘জীবন মানে যন্ত্রণা’ নামে নতুন একটি নাটক মঞ্চে আনার পরিকল্পনাও করছে তারা।
বিক্রমপুর শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রুবেল হোসেন টুকু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নাটক হলে মিলনায়তন দর্শকে ভরে যায়, অনেক দর্শক আসে। তবে সবাই একটু রাতের বেলা আসে। আমরা ৭টায় নাটক শুরু করি। সেটা যদি রাত ৮টায় করা যায়, তবে ভালো হত। কিন্তু সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ ১০টার মধ্যে মঞ্চায়ন শেষ করতে বলেন। এটা রাত ১১টায় শেষ করলে ভালো হয়।”
সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ‘কারিগরী ব্যবস্থা’ কেমন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “লাইট, সাউন্ডের কোনো সমস্যা নাই। এসিও ঠিক করা হয়েছে। কর্মীরাও যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। তবে লিফট সব সময় চলে না। এতে বয়ষ্ক মানুষদের কষ্ট হয়।”
জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক অমরেশ মণ্ডল বলেন, “কিছুদিন আগেও কিছু সমস্যা ছিল। এখন সংস্কার করা হয়েছে। এসি, লাইট, সাউন্ডের কোনো সমস্যা নাই। নাটক করার মত ভালো সুযোগ-সুবিধা আছে।”
সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সামনেই একটি ফলের দোকানে পাওয়া গেল শামীম আহমেদ নামে স্থানীয় একজনকে। তিনি বললেন, “এখানে যে নাটকই হয়, দর্শক ভালোই হয়। কিন্তু নাটক তো বেশি হয় না।”
নাটকের প্রদর্শনী হলে যে দর্শক আসে, সে কথা অমরেশ মণ্ডলও বললেন।
“নাটকের সময় দর্শক আসে। টিকেট কেটেই নাটক দেখে লোকজন। কিন্তু নাটক তো সব সময় হয় না। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের দলগুলোর জন্য ভাড়া কমানো হয়েছে। তবু তারা আসে না এখানে।”
নাচ, গানসহ অন্য সাংস্কৃতিক আয়োজন একদমই হয় না জানিয়ে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক বলেন, “কেন্দ্রের মিলনায়তনটি শুরুই হয়েছিল নাট্যোৎসব দিয়ে। কিন্তু পরে ঢাকার মূলধারার নাট্যদলগুলো আর আসছে না।”
আগ্রহের অভাব কেন?
এই প্রশ্ন করলে ঢাকা মহানগর নাট্য পর্ষদের আহ্বায়ক ঠান্ডু রায়হান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকার নাট্যচর্চা তো অনেকটাই সেগুনবাগিচার শিল্পকলাকেন্দ্রিক। নাট্যদলগুলোর অফিসও বেশিরভাগ শিল্পকলার আশপাশে।
“জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে নাটকের মঞ্চায়ন করতে হলে সেটসহ অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়াটা অনেক ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। দলগুলো তো টিকেট বিক্রির ওপর নির্ভরশীল। মিলনায়তনের ভাড়াও বেশি। দলগুলোর নিজের ব্যবস্থাপনায় সেখানে গিয়ে শো করা কঠিন।”
তবে প্রণোদনা দেওয়া হলে সেখানেও অনেক নাট্যদল প্রদর্শনী করতে যাবে বলে মনে করেন ঠান্ডু রায়হান। তিনি বলেন, “শিল্পকলা একাডেমি প্রণোদনামূলক নাট্যোৎসব আয়োজন করতে পারে। এছাড়া বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ও সেখানে কিছু উৎসব আয়োজন করা উচিত। ওই এলাকার স্থানীয় সংগঠনগুলোকেই এমন উদ্যোগ নিতে হবে।”
শিল্পকলা একাডেমি থেকে জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কোনো উৎসবের পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে নাট্যকলা বিভাগের পরিচালক ফয়েজ জহির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা তো সিটি করপোরেশনের অধীনে। সেখানে এখন পর্যন্ত আমাদের কিছু করার পরিকল্পনা হয়নি।
“জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে উৎসবের আয়োজন করা যায় কিনা, তা নিয়ে আমার অফিসে আলোচনা করব। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সেখানে উৎসব আয়োজন করা উচিত।”
জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে প্রাণ ফেরাতে হলে স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনকে সক্রিয় করার পাশাপাশি ভাড়া কমানোর ওপর জোর দিচ্ছেন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আক্তারুজ্জামান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনকে সক্রিয় করতে না পারলে, অন্য জায়গার সংগঠন গিয়ে সেখানে নিয়মিত অনুষ্ঠান আয়োজন করাটা কঠিন।”
স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে নাট্যোৎসব করার পরিকল্পনা জানিয়ে ঠান্ডু রায়হান বললেন, “যৌথভাবে একটি নাট্যোৎসব করা যায় কিনা, সেই চিন্তা করা হচ্ছে।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী হাসান আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জহির রায়হানের নামে যে সূত্রাপুরে একটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আছে, সেখানে পাঠাগারও করা হয়েছে, তা হয়ত অনেকে জানেন না। এজন্য কিছুদিন প্রণোদনা দিয়ে বিভিন্ন উৎসব, নাটকের প্রদর্শনীসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান করা উচিত।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরান ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সেসব কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার কথা বলেন হাসান।
তিনি বলেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব সক্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে। তাদেরকে যুক্ত করলে এবং প্রণোদনা দেওয়া হলে এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্র জমজমাট হবে।”
মিলনায়তনের ভাড়া বেশি হওয়ার কারণেও অনেক সংগঠন উৎসাহ হারাচ্ছে বলে মনে করেন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের আক্তারুজ্জামান।
তিনি বলেন, “এটি যখন শুরু করা হয়, তখন সম্ভবত সাড়ে ৩ হাজার টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে সেটি ৫ হাজার করা হয়। এখন মনে হয় ৭ হাজার টাকা করা হয়েছে, এর সঙ্গে ভ্যাট-ট্যাক্সের ব্যাপারও আছে। ভাড়া কমালে, অর্থাৎ টোকেন ভাড়ায় বরাদ্দ দেওয়া হলে হয়ত নাট্যদলগুলো আগ্রহী হবে।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক অমরেশ মণ্ডল বলেন, “ভাড়া কমানোর এখতিয়ার তো আমার হাতে নাই। একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নাট্যদলগুলো আবেদন জানাতে পারেন। পরে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবেন।”
মূলধারার নাটকের দলগুলোর জন্য ভাড়া কমানো বা নামমাত্র ভাড়ায় মিলনায়তন বরাদ্দ দেওয়ার দাবির বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলামের কাছে জানাতে চাওয়া হয়েছিল। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যদি আমাদের আবেদন করা হয়, সেটি যথাযথ প্রক্রিয়াতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এরকম কোনো দাবি আমাদের এখানে এসেছে কিনা, তা কাগজপত্র দেখে বলতে হবে।”