
আমার কাগজ প্রতিবেদক
আজ ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলদেশেও পালিত হচ্ছে দিবসটি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘ আছে ১২৫টি। পরিবেশবিদদের দাবি, বাঘের সংখ্যা আরও বাড়াতে প্রয়োজনীয় আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে বনবিভাগ বলছে, সরকার বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহন করায় বাঘের সংখ্যা বাড়ছে, এটি অব্যহত থাকবে।
বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০২৩-২০২৪ সালে সুন্দরবনে পরিচালিত বাঘ জরিপে বাঘের সংখ্যা ১২৫টি পাওয়া যায় এবং প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটার বনে বাঘের ঘনত্ব পাওয়া যায় ২ দশমিক ৬৪। সেই হিসেবে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০১৫ সালের তুলনায় বাঘের সংখ্যা ১৭ দশমিক ৯২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে ৩য় পর্যায়ে বাঘ জরিপ ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হয়ে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে শেষ হয়। এই বাঘ জরিপে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা, খুলনা, চাঁদপাই ও শরনখোলা রেঞ্জে চারটি ব্লকে ৬০৫টি গ্রিডে স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। ৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রতিটি গ্রিডে বাঘের গতিপথ, বিচরণ, অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে সতর্কতার সাথে ২টি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। ৬০৫টি গ্রিডে পর্যায়ক্রমে ১ হাজার ২১০টি ক্যামেরা মোট ৩১৮দিন রেখে দেওয়া হয় এবং ৩৬৮টি গ্রিডের ক্যামেরায় বাঘের ছবি পাওয়া যায়।
জরিপকালে প্রাপ্ত বাঘের ছবি ও অন্যান্য তথ্য উপাত্তসমূহ সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পে নিয়োজিত বাঘ বিশেষজ্ঞ কর্তৃক বিশ্লেষণ ও যাচাই বাছাই করে বাঘের সংখ্যা ও বাঘের ঘনত্ব নিরূপণ করা হয়।
তবে শুধু ক্যামেরা ট্রাপিংই নয় সুন্দরবনে ঘুরতে আসা পর্যটক ও বনরক্ষিরা বিভিন্ন সময় বাঘের দেখা পাচ্ছেন। সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী লোকালয়ের বাসিন্দারা মনে করেন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়ছে বাঘের সংখ্যা।
শরণখোলা উপজেলা বিএনপির নবনির্বাচিত সভাপতি আনোয়ার হোসেন পঞ্চায়েত বলেন, সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা শরণখোলা উপজেলায় গত কয়েক বছর ধরে বাঘের দেখা মিলছে। এমনকি বন বিভাগের অফিসের পাশেও বাঘের আনাগোলা লক্ষ্য করেছে বন বিভাগের কর্মীরা। এসে বোঝা যাচ্ছে বাঘের সংখ্যা আগে থেকে বেড়েছে। সুন্দরবনের পাশের মানুষের বনের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারলে সুন্দরবন ভালো থাকবে, ভালো থাকবে বাঘ ও হরিণ।
সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ লায়ন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের বাঘ হচ্ছে বাংলাদেশের একটি অন্যতম সম্পদ। বাঘ বাঁচতে সুন্দরবন বাঁচবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। বাঘের সুরক্ষা করা আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই বাঘের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে বন বিভাগকে আরও টহল বাড়াতে হবে। যে সমস্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা আছে সেখানে ড্রোনের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশে বাঘের যে চামড়া ও হাড় পাচার হয় সেটা বিষয়ে আমাদের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানির উচ্চতা ও লবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে সুন্দরবনের মধ্যে পানি বেড়ে যাচ্ছে। ফলে জোয়ারের সময় পানি বেড়ে বাঘের আবাসস্থল ও বাঘের জন্য থাকা সুপেয় পানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাঘের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের যে ঝুঁকি এটি মাথায় রেখে পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে বলে দাবি করেন এই বিশেষজ্ঞ।
বাগেরহাট সরকারী পিসি কলেজের উপাধ্যক্ষ ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. শিউলী রানী সূত্রধর বলেন, বাঘ আমাদের দেশের জীববৈচিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু নির্বিচারে বন উজার, বাঘের আবাসস্থান ধ্বংস, চোরা শিকারীদের দৌরাত্ম, বাঘের প্রজননে বিঘ্ন ঘটানো, বাঘের খাদ্য সংকট, সর্বোপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এগুলো আশঙ্কাজনক হারে বাঘের সংখ্যা কমিয়ে আনছে।
তিনি বলেন, বাঘের সংখ্যা বাড়াতে কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। বাঘের যে প্রাকৃতিক আবাসস্থল সেটি সুরক্ষিত করতে হবে। বনজীবীদের জন্য বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। চোরাশিকারীদের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বাঘের খাদ্য যেমন, হরিণ, বুনো শুকর, বুনো মহিষের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বাঘের নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করতে বনের পাশে থাকা কল-কারখানা বন্ধ, নদীতে উচ্চ শব্দে চলা নৌযান চলাচল বন্ধ করতে হবে।
সুন্দরবন পুর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনে বাঘের পপুলেশন আগের থেকে ভালো। সর্বশেষ জরিপে আগের জরিপ থেকে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ১২৫টি বড় বাঘ রয়েছে। এর বাইরে মাঝারি ও অনেক বাঘের বাচ্চাও রয়েছে। আর্ন্তজাতিক ভাবে বাঘ ঝুঁকিপূর্ণ প্রাণী। বাঘ শিকার বন্ধে নানা পদক্ষেপ গ্রহন করা হচ্ছে।
সুন্দরবনে টহল জোরদার ও লোকালেয়ে আসা বাঘ নিরাপদে বনে ফেরাতেও ব্যপক জনসচেতনতা তৈরি করা হয়েছে বলে জানান বনবিভাগের এই কর্মকর্তা।
সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য সর্বপ্রথম ২০১৫ সালে আধুনিক পদ্ধতি ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ জরিপ করা হয় এবং এ জরিপে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ১০৬টি এবং প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটারে বাঘের ঘনত্ব ছিল ২ দশমিক ১৭। ২০১৮ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ে ক্যামেরা ট্রপিংয়ের মাধ্যমে সুন্দরবনের বাঘ জরিপে ১১৪টি বাঘ পাওয়া যায় এবং প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটারে বাঘের ঘনত্ব ছিল ২ দশমিক ৫৫। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে বাঘ বৃদ্ধি পায় ৮টি এবং বাঘ বৃদ্ধির শতকরা হার ছিল প্রায় ৮ শতাংশ।