
রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন উন্নয়ন হলেও ও জেলা সদরের সঙ্গে সড়ক নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়নি দেশের বৃহত্তম দুই উপজেলা রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি ও লংগদু। বাঘাইছড়ি উপজেলা রাঙ্গামাটি জেলার বড় উপজেলা নয়, দেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা হিসেবে পরিচিত।
অথচ যোগাযোগব্যবস্থার ঘাটতির কারণে পাহাড়ি জনপদের মানুষ নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানিয়ারচর-লংগদু আঞ্চলিক সড়কের মাত্র ২৪ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ হলেই রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির পাঁচ উপজেলার পাঁচ লাখ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। খুলে যাবে সমৃদ্ধির নতুন দুয়ার। কৃষিপণ্য বিপণন ও পর্যটনে তৈরি হবে গুরুত্বপূর্ণ হাব। মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও নিরাপত্তার পাশাপাশি বছরে বাণিজ্য হবে কয়েক হাজার কোটি টাকার।
শুধুমাত্র একটি সড়কই বদলে দিতে পারে পাহাড়ের অর্থনীতি। সড়কটি ঘিরে থমকে আছে পাহাড়ের কয়েক লাখ মানুষের স্বপ্ন আর যোগাযোগ ব্যবস্থার নয়া দিগন্তের হাতছানি।ইতোপূর্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন এই সড়কের নানিয়ার চর সেতু নির্মাণের পর সড়ক নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু করলেও তা মাঝপথেই থেমে যায়। তবে এরই মধ্যে জনগুরুত্ব বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগ। তাই সড়কটি দ্রুত নির্মাণে সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন পাহাড়ের বাসিন্দারা।
জানা গেছে, বিশেষ ভৌগলিক অবস্থার কারণে পাহাড়ের সব উপজেলা এখনো জেলা সদরের সঙ্গে সড়ক নেটওয়ার্কের আওতায় আসেনি। এর সঙ্গে গত শতকের ১৯৬০ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ হলে কৃত্রিম হ্রদের কারণে দূরবর্তী বেশ কয়টি উপজেলার মতো নানিয়ারচর, লংগদু ও বাঘাইছড়িও পানিবন্দি হয়ে জেলা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেখানে যোগাযোগব্যবস্থায় নৌযান একমাত্র ভরসা হওয়ায় উৎপাদিত কৃষিপণ্যের পরিবহন ও বাজারজাত করা যেমন ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে, তেমনি যাতায়াতেও সৃষ্টি হয় নানান ভোগান্তি। তবে ২০২০ সালে নানিয়ারচরের চেঙ্গী নদীতে ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণের পর পাহাড়ে সমৃদ্ধির নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হয়।
এদিকে ৩৭ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বগাছড়ি-নানিয়ারচর-লংগদু আঞ্চলিক সড়কটির সাড়ে ১৩ কিলোমিটার অংশ আগে থেকেই পাকা ছিল। অবশিষ্ট ২৪ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ হলেই জেলা সদরের সঙ্গে সড়ক নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে। এতে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর, লংগদু, বাঘাইছড়ি, খাগড়াছড়ি ও দীঘিনালা এই পাঁচ জেলা-উপজেলার অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ সড়কটি ব্যবহার করতে পারবেন। এই সড়ক ধরে পাহাড়ি জনপদে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাতে খরচ ও সময় সাশ্রয়সহ কৃষি অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে তেমনি মেঘের রাজ্য হিসেবে খ্যাত সাজেকের সাথে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। আর সড়ক যোগাযোগ, পর্যটন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায়ও আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
বাঘাইছড়ির কাচালং ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ কামাল হোসেন জানান, পাহাড়ের অনেক ছেলে মেয়ে পড়ালেখায় ভালো করে। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না থাকায় তাদের মেধার বিকাশ হয়না। রাঙ্গামাটি জেলা সদরের সাথে বাঘাইছড়ি উপজেলার যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হলে এই এলাকার মানুষের আর্ত্মসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী হবে এলাকার মানুষ।
সম্প্রতি নানিয়ারচরের বড়পুলপাড়ায় গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা হলে এসব চিত্র ফুটে উঠে। গ্রামটির বাসিন্দা পলেন চাকমা বলেন, ‘এ সড়কটিতে প্রয়োজনীয় সব কয়টি সেতুই আছে। এখন দরকার সড়ক নির্মাণ। সড়ক হলে লংগদু থেকে নানিয়ারচরে যাতায়াতে সবকিছুতেই সুবিধা হবে। গ্রামবাসী কৃষিপণ্য খুব সহজে বাজারে নিতে পারবে। দামও ভালো পাবে।’
পলাশ চাকমা নামে ওই এলাকার আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদের এদিকে আনারস, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফল ও সবজির চাষ হয়। এই রাস্তাটি হলে আমাদের মালামাল পরিবহনে সময় ও খরচ দুই-তৃতীয়ংশই বেচে যাবে।’তাছাড়া অন্তসত্তা নারী ও জরুরি রোগীর যাতায়াতে খুবই অসুবিধা হয়। বর্ষাকালে তো পা ফেলাই যায় না।’
লংগদু উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন জানান, এই একটি সড়ক হলে লংগদুর সাথে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা দুই থেকে তিন ঘণ্টা কমে যাবে। এলাকার জেলেরা মাছ ও কৃষকরা উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যসহ সকল পাহাড়ি পণ্যের সঠিক দামও পাবে এবং দেশবাসীও মান সম্পন্ন পণ্য পাবে। এর সঙ্গে এই এলাকায় পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন হবে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। নানিয়ারচর থেকে লংগদু সড়কটি নির্মাণ হলে লংগদু, বাঘাইছড়ির মানুষদের খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ঘুরে রাঙ্গামাটি যাওয়া লাগবে না। তখন তারা দ্রুতরাঙ্গামাটি যাতায়াত করতে পারবে। বাঘাইছড়ি উপজেলা থেকে খাগড়াছড়ি হয়ে রাঙ্গামাটি জেলা শহরে যাতায়াতে এখন ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা লাগলেও সড়ক হলে লাগবে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা।’
নানিয়ারচর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. নুরুজ্জামান বলেন, নানিয়ারচর সেতু হলেও এখনো নির্মাণ হয়নি নানিয়ারচর-লংগদুর এই জনগুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটি। এই সড়কটি নির্মাণ এখন সময়ের দাবি।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য মিনহাজ মুরশীদ বলেন, ‘প্রস্তাবিত এ সড়কটি পাহাড়ের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। নানিয়ারচরের বড়পুল থেকে মাত্র ২৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হলে লংগদু হবে কৃষিপণ্য বিপণন ও পর্যটনের গুরুত্বপূর্ণ হাব। এতে বছরে বাণিজ্য হবে কয়েক হাজার কোটি টাকার। মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্যও কাজে আসবে। পর্যটকরাও সাজেক থেকে লংগদু-রাঙ্গামাটি-বান্দরবান হয়ে স্বল্প সময় ও খরচে কক্সবাজার যেতে পারবেন। তাই সড়কটি দ্রুত নির্মাণে বর্তমান সরকারের হস্তক্ষেপ চাই।’
রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, ‘মাত্র ২৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হলেই পথটি সচল হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে আমরা একটি ডিও লেটার পেয়েছি। জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় সড়কটি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে আমরা মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করেছি। যেন ভবিষ্যতে কোনো প্রকল্পের আওতায় উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়। সড়কটি নির্মিত হলে রাঙ্গামাটি জেলার সঙ্গে লংগদু-বাঘাইছড়ি উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। পর্যটন এলাকা মেঘের রাজ্য খ্যাত সাজেকের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে।’