হাওর অঞ্চল প্রতিনিধি
নিকলীতে ফুট ব্রীজ নয় যেন মরণফাঁদ। ঝুকি নিয়ে ফুট ব্রীজের উপর দিয়ে ছোট বড় বিভিন্ন ধরণের গাড়িতে চড়ে ও পায়ে হেঁটে চলাচল করে প্রতিদিন কয়েক হাজার লোক। গাড়ী চলাচলের অযোগ্য ও অপরিকল্পিত এই ফুট ব্রীজ শুরু থেকেই ছিলো ঝুঁকিপূর্ণ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিকলীর কারার মাহমুদুল হাসানের একক প্রচেষ্টায় এলজিইডি সচিব থাকাকালীন সময়ে ২০০০ ও ২০০১ অর্থবছরে নির্মিত এই ফুট ব্রীজ। নিজেস্ব জমি জমার ফসল আনা-নেয়াসহ স্থানীয় এলাকাবাসীর সুবিধার্থে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাহীন নরসুন্দার উপর ৯৯ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৬ ফিট প্রস্থের কাছাকাছি মোহরকোনা ও কামালপুরের মধ্যবর্তী ফুট ব্রীজটি নির্মাণ করেন। এছাড়াও একই সময়ে দ্বিতীয়টি সচিবের বাড়ি সংলগ্ন নরসুন্দা নদীর অংশ বিশেষে সোয়াজনি নদীতে নিমাণ করেন। তৃতীয়টি নির্মাণ করেন দামপাড়া ও মজলিশপুর বাজার ঘাটে। এ সময়ের তিনটি ব্রীজ প্রায় একই ধরণের আকৃতির। তবে তুলনামূলক বিপদজনক মোহরকোনার ব্রীজটি। পরিকল্পনাহীন এ সব ফুট ব্রীজ নির্মাণের কারণে প্রতি বছরই ঘটে চলেছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। এমনি এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন ব্রীজের কাছাকাছি বসতি মোবারক নামের এক রিকশা চালক।
পরিবারের আহাজারি বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। কিভাবে ৪টি সন্তান নিয়ে সংসার চালাবেন। মোবারক হোসেনের স্ত্রী তানিয়া আক্তার চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়েছেন। স্বামীর তিন চাকার গাড়ির উচিলায় চলতো অসহায় এই পরিবারের সংসার। বিধিবাম গত ২৯ জানুয়ারি বুধবার নিত্য দিনের মতো গাড়ি নিয়ে বের হলেও আর ঘরে ফেরা হলো না স্বামী মোবারকের।
কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলা সদরের মোহরকোনা ব্রীজের ঢালে মরণফাঁদের কাছে বিকালে গাড়ি ঘুরাতেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িসহ মোবারক ব্রীজের ঢালেতে পড়ে যান। বাঁচানোর লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে স্বজনেরা বাজিতপুরের জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। অবস্থা বেগতিক দেখে চিকিৎসকরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরমর্শ দেন। ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পথে নরসিংদী এলাকার রাস্তাতেই তার মৃত্যু হয়। এ তথ্য নিশ্চিত করেন নিহতের পরিবার।
মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার পর থেকে নিকলী শহীদ স্মরণীকা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর অধ্যয়নরত বৃষ্টি আক্তার এবং মহরকোনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী তাবাসসুম পিতৃশোকে ভেঙে পড়ে। এ সময়ে অসহায় শিশুদের বলতে শোনা যাচ্ছে এখন তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব কে নিবে, কিভাবে লেখাপড়া করবে! অবুঝ ৫ বছরের একমাত্র ছেলে সাইফ ও সাড়ে ৩ বছরের শিশু কন্যা রওজা অপলক তাকিয়ে রয়েছে নানান মানুষের মুখ পানে। পিতার অভাব বুঝতে না পারলেও অবুঝ দুইটি শিশু মাঝে মাঝে পিতাকে খুঁজে ফিরছেন বাবা বলে। দুই চালা জরাজীর্ণ একটি ছোট ঘরে গাদাগাদি পরিবেশে বসবাসকারী পরিবারটির অল্প ভিটে ভূমি ছাড়া আর কোনো সহায়-সম্পত্তি নেই। সহযোগীতার লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত কোন মহলের কেউ এগিয়ে আসেননি বলেও জানান পরিবারের সদস্যরা। তবে স্থানীয়দের ভাষ্য এই পরিবারে উপার্জনশীল দ্বিতীয় আর কেউ নেই।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অভাবে নির্মিত এই ফুট ব্রীজ আবু বকরের মতো অসংখ্য চালক ও যাত্রীদের জীবন কেড়ে নিয়েছে। অনেকে হয়েছে পঙ্গুত্বের সাথে সর্বশান্ত। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানেও একই স্থানে অপরিচিত এক চালকেরও করুন মৃত্যুর পরিনতি হয়েছে বলে জানান স্থানীয় শিক্ষক হোসেন আলী। এছাড়াও তথ্য মিলেছে এক বছরের ব্যবধানে সদর নাগারহাটির আব্দুল কুদ্দুসসহ কটিয়াদী উপজেলার সহশ্রমের এক পুরুষসহ ও দামপাড়া ইউনিয়নের আলীয়াপাড়ার নারী মৃত্যুর ঘটনা।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, অজানায় রয়ে যায় দূরদূরান্তের যাত্রী ও চালকদের দূর্ঘটনাজনীত মৃত্যুর খবর। মোহরকোনা দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক হোসেন আলীসহ অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, এ ফুট ব্রীজের কারণে প্রতিবছরই দুই একজনের দূর্ঘটনাজনীত অকাল মর্মান্তিক মৃত্যুর দৃশ্য ও খবর চোখে পড়ে। আহতদের সংখ্যা দুই যুগে কয়েক হাজার হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সরেজমিনে উঠে এসেছে ব্রীজে উঠা নামার সময়ে নিয়ন্ত্রণ হারালেই ব্রীজের ঢালে পড়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয় যাত্রী ও চালকেরা।
তুলনামূলক উঁচু আর সরু এই ফুট ব্রীজের ঢালেও নেই কোন ধরণের প্রতিরোধক ফিলার বা বর্ডার গার্ডার। ব্রীজের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে কিছুই দেখা যায় না। দুটো গাড়ি কোন মতেই অতিক্রমও করা সম্ভব হয়ে উঠে না। যাত্রী নিয়ে এই ব্রীজ অতিক্রম করা মানেই মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা নড়া। ফুট ব্রীজটির নিচে কয়েক বছরে ধরে বিপদজনক সংকেত লেখা থাকলেও সময় বাঁচাতে বিভিন্ন ধরণের মালবাহী ও যাত্রীবাহী গাড়িকে ঝুকি নিয়েই নিয়মিত পাড়াপার হতে দেখা যাচ্ছে। একেকটি করুন মৃত্যুর পর কয়েকদিন পাহাড়ায় থাকতে দেখা গেলেও পরবর্তীতে আর পাহাড়ার দায়িত্বে থাকাদের দেখা মিলে না। এমন তথ্য নিশ্চিত করে স্থানীয়রা।
স্থানীয় এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে ২০২৪ সালে ২৪ জানুয়ারিতে পুনরায় ব্রীজ নির্মাণের লক্ষ্যে কাছাকাছি অংশে ১২২.৫২ মিটার দৈর্ঘ্যর ২৬ কোটি ২৮ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকা ব্যয় বরাদ্দের কাজ শুরু হলেও স্থবির অবস্থায় রয়েছে। স্থানীরাও একোয়ারজনীত সমস্যায় বিলম্বের কারণ বলে জানান।
ব্রীজের কাছাকাছি কামালপুর এলাকার কামরুল হাসান বলেন, এই স্থানটিতে ব্রীজের গুরুত্ব জনগণের কাছে অনেক বেশি। সদরসহ একাধিক ইউনিয়নের কয়েক হাজার জনগণ ও ছোট-বড় শতশত গাড়ি ঝুকি নিয়েই নিয়মিত পাড়াপাড় হচ্ছে। দূর্ঘটনা এড়াতে সরকারিভাবে নজরদারি ও তদারকি অতি জরুরী বলেও দাবি তোলেন।
অসংখ্য স্থানীয় ও সচেতনদের দাবি এই মরণফাঁদ ঠেকাতে হলে দ্রুত নিচের বর্ডার গার্ড নিমাণসহ নিয়মিত সিগন্যালের দায়িত্ব পালনকারী একাধিক ব্যক্তিকে সতর্কতার লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে নিযুক্ত রাখতে হবে।
নিকলী থানার অফিসার ইনচার্জ কাজী আরিফ উদ্দিন দূর্ঘটনার বিষয়ে অবগত নন বলে স্বীকার করেন। পাশাপাশি ব্রীজটি ঝুঁকিপূর্ণ বলেও সহমত পোষণ করেন।
নিকলী উপজেলা প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম এক প্রশ্নের জবাবে জানান, ২৭ জানুয়ারি তিনি নিকলীতে যোগদান করেছেন। এখানকার ফুট ব্রীজের সার্বিক দিক খতিয়ে দেখবেন বলেও জানান।
নিকলী উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা পাপিয়া আক্তার মোহরকোনা ব্রীজটি দুর্যোগপূর্ণ স্বীকারের পাশাপাশি অপর একটি ব্রীজ নির্মাণ হতে চলছে বলেও জানান। এছাড়াও নিহত মোবারকের পরিবারের অসহায়ত্বের দিকটাও বিবেচনাধীন রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।