কুমিল্লা প্রতিনিধি
বন্যার প্রায় ৪ মাস পর বিপাকে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের মৎস্য চাষিরা। সাম্প্রতিককালের বন্যায় ভেসে যাওয়া খামার, পুকুরের পানি সেচে কাঙ্ক্ষিত মাছ না পেয়ে এসব চাষিরা জানিয়েছেন নিজেদের হতাশার কথা। বানের পানিতে ভেসে যাওয়ার পর কিছু মাছ আছে ভেবে চাষিরা এক-বুক আশা নিয়ে এসব খামারে খাদ্য বাবদ করেছেন অর্থ বিনিয়োগ। অবশেষে পানি সেচের পর মাছ তো নেই বরং সেচের টাকাও গচ্ছা দেওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেকেই।
ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দিশেহারা চাষিরা এখন দুশ্চিন্তায় সময় পার করছেন। পুঁজি হারিয়ে অধিকাংশ চাষি পথে বসেছেন। কেউ কেউ ক্ষতি পুষিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। তারা পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে এসব চাষিরা কর্তৃপক্ষের কাছে প্রণোদনাসহ চান ঋণ সহায়তা। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের কেউ কেউ খালি পড়ে থাকা ঐসব খামারে নেমেছেন বোরো অবাধে।
উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, গেল বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুতে প্রায় দুই মাসব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় ভেসে গেছে প্রায় ৮০ কোটি টাকার মাছ। বন্যায় এ উপজেলায় সবচেয়ে বিপর্যস্ত হয়েছে মস্যখাত। এ খাতে মৎস্যচাষিরা অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এবারের বন্যায় প্রায় ৩ হাজার ৯শ ৪০টি পুকুর/দিঘীর মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ভেসে গেছে। চাষাবাদের জন্য মজুদ রাখা প্রায় ৭০ লক্ষ পোনা মাছও ভেসে গেছে পানিতে। তাছাড়া পুকুর/দিঘীর পাড় ভেঙ্গে ও বিভিন্ন খামারের অবকাঠামো নষ্ট হয়ে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে চাষিরা।
এ এলাকার অন্তত ২০ জন প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিদের সাথে কথা হলে তারা জানান, এবারের বন্যায় অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে চাষিরা। সর্বস্ব হারিয়ে পুঁজি সংকটে পড়েছেন তারা। বন্যার পানি নামার পর উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর থেকে ১০ কেজি মাছের পোনা নিয়েই বাড়ি ফিরলেন হাতেগোনা কিছু চাষি। এতে চাষিদের মাঝে দেখা গেছে হতাশার চিত্র। এটা অতি নগণ্য উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশে অনেকেই বলেন যেখানে চাষিদের লক্ষ লক্ষ টাকার মাছ ভেসে গেছে সেখানে প্রণোদনা বাবদ সামান্য মাছের পোনা দেয়া তামাশার নামান্তর মাত্র। তাও আবার প্রতি ইউনিয়নে দশ জন করে। এ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষিরা সম্ভাবনাময় এ খাতকে সচল ও নিজেদের এ পেশায় নিয়োজিত রাখতে প্রণোদনাসহ ঋণ সহায়তার দাবী জানান তারা।
লত্সর সমবায় মৎস্য প্রকল্পের সদস্য সাইফুল, সোহাগ ও রুবেলসহ কয়েকজন সদস্য জানান, ১১জন সদস্য প্রায় সাড়ে ৪ হেক্টর আয়তনের এ প্রকল্পে মাছচাষে যৌথভাবে বিনিয়োগ করেন তারা। বন্যার আগে এ প্রকল্পে মাছ ও মাছের খাদ্যবাবদ প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করার কথা জানান তারা। বানের পানিতে প্রকল্পের অধিকাংশ জায়গা ডুবে গেলে প্রকল্পের চারপাশে নেটজাল দিয়ে মাছ রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টাও করেন। নেটজাল দিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি তাদের, তা বুঝতে পারার আগেই অনেক বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। প্রকল্পে মাছ রয়েছে এমন ভেবে বন্যা পরবর্তী সময়ে আরও প্রায় ২ লক্ষাধিক টাকা মাছের খাদ্যবাবদ বিনিয়োগ করেন। সম্প্রতি সেচ দিয়ে এ প্রকল্পের মাছ বিক্রি করেছেন মাত্র সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। পুঁজি হারিয়ে হতাশায় ভুগছেন এ প্রকল্পের সদস্যরা। এ প্রকল্পের আরও একাধিক পুকুরে পরবর্তী বছরের জন্য মজুদ রাখা প্রায় ২৫ হাজার পোনা মাছও থেকে বানের পানিতে ভেসে যাওয়ার কথা জানান তারা।
সামিন মৎস্য খামারের সত্ত্বাধিকারী জহির রায়হান এর সাথে কথা হলে তিনি জানান, বানের পানিতে ভেসে যাওয়া বেশ কয়েকটি খামারের মধ্যে তিনটি খামারে মাছ আছে ভেবে বন্যা পরবর্তী সময়ে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা বিনিয়োগও করেছেন, সম্প্রতি এসব খামার সেচে পুঁজি তো দুরের কথা পানি সেচের টাকাও উঠাতে না পারার অভিযোগ করেন তিনি। বন্যার আগে মাছ চাষের পাশাপাশি ব্যাংক লোন নিয়ে তিনি নিয়েছেন কাজী ফিস ফিডের ডিলারশিপ। নিজের খামারের পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মত্সচাষিদের খাদ্য সরবরাহ করতেন তিনি। অনিশ্চয়তায় পড়েছে তাদের কাছে পাওনা বকেয়া টাকাও। সবকিছু তকদিরের উপর ছেড়ে দিয়ে হতাশাগ্রস্ত এ ব্যবসায়ী ব্যাংক লোন ও কোম্পানির অপরিশোধিত টাকা পরিশোধ নিয়ে হতাশায় ভুগছেন।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাসিরুল ইসলাম এর সাথে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি ইত্তেফাক-কে জানান, বন্যা পরবর্তী সময়ে এ উপজেলায় ১শ দশজন প্রান্তিক চাষিকে ১০ কেজি করে পোনা মাছ দেওয়া হয়েছে যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের ঋণ সহায়তা বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পাশাপাশি পরবর্তীতে বরাদ্দ প্রাপ্তি সাপেক্ষে চাষিদের সহযোগিতা করা হবে।