মোক্তাদির হোসাইন, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
বৈষম্যকে নির্বাসনে পাঠাবো প্রত্যয় ব্যক্ত করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা: শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, স্বৈরাচারকে আমরা তাড়াতে পারিনি, বিদায় করতে পারিনি। আমি গর্বিত আমাদের সন্তানেরা সেই কাজটি করেছে। আমি আমাদের সন্তানদেরকে ভালবাসা উপহার দিচ্ছি। শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। জাতির পক্ষ থেকে তাদেরকে স্যালুট জানাচ্ছি। আল্লাহ তায়ালার সাহায্যে তারা অসাধ্য সাধন করেছে। এরকম সন্তান পেয়ে জাতি গর্বিত। ইনশাআল্লাহ আগামির বাংলাদেশ আমরা তাদের হাতেই তুলে দিবে।
শনিবার (২১ ডিসেম্বর) দুপুরে মৌলভীবাজার জেলা জামায়াত আয়োজিত কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জেলা জামায়াতের আমীর ইঞ্জিনিয়ার মো. শাহেদ আলীর সভাপতিত্বে ও সেক্রেটারি মো. ইয়ামির আলী, সহকারী সেক্রেটারি হারুনুর রশিদের যৌথ পরিচালনায় সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, ঢাকা মহানগর উত্তরের আমীর ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, সিলেট মহানগর জামায়াতের আমীর মো. ফখরুল ইসলাম ও সিলেট জেলা আমীর মাওলানা হাবিুবুর রহমানসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
হাফেজ মাহবুবুর রহমানের অর্থসহ কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে কর্মী সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশন করেন জেলা মৌলভীবাজার সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংসদের শিল্পীগোষ্ঠী।
ঘন কুয়াশা আর শীতের কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে হাজার হাজার কর্মী সমর্থক সকাল থেকে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকসমাগম বাড়তে থাকে সম্মেলন স্থলে। বক্তব্যের শুরুতেই জুলাই বিপ্লবের বীরদের একটি ¯েøাগান ‘বুকের ভিতর তুমুল ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর, উচ্চারণ করে। তাদের ক্ষোভটা ছিল সাড়ে ১৫টা বছর। এসময়টায় তারা জাতির ঘাড়ে বসে সকল অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। দেশটাকে শ্মশান কিংবা গোরস্তানে পরিণত করেছিল। এরা মাঝে মাঝে বলতো দেশে নাকি অনাবিল শান্তি বিরাজ করছে। আমরা বলতাম শান্তি তোমরা কায়েম করেছো কবরের মতো। যেখান থেকে হাসি কিংবা কান্নার শব্দ শোনা যায় না। কবরস্থানে কোন মানুষ থাকে না। হাসি কান্নার আওয়াজ শোনা যায় না। ২৮ অক্টোবর তারা লাশের ওপর নর্দন করেছে। তখনই তারা জানান দিয়েছিল যে ক্ষমতায় এসে খুন-গুমের রাজ্য কায়েম করবে। আমরা সেদিন আমাদের বুকের কান্না বাংলাদেশের মানুষের কাছে হয়তো বা পৌঁছাতে পারিনি। এরপর পেছনে বোঝাপড়া করে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং একটি জগন্য সরকারে হাত ধরে করে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে তারা জয়লাভ করেছিল। ২০০৯ সালের ১০ জানুয়ারি ক্ষমতায় বসে খুনের নেশা বাস্তবায়নের কর্মসূচি হাতে নেয়।
তিনি বলেন, প্রথমে তারা খুন করে সেনাবাহিনীর চৌকস ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তাকে পিলখানায়। ২৫ এবং ২৬ ফেব্রæয়ারি। দুই মাস না যেতেই তারা খুনের রাজত্ব কায়েম করে। সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেয়। বিডিআর বাহিনী ধ্বংস করে সেই বাহিনীর সাড়ে ১৭ হাজার সদস্যকে চাকুরীচ্যুত করলো। সাড়ে ৮ হাজারকে জেলে দিলো। জেলের ভেতর সাড়ে ৩শ’র অধিক মারাই গেল। আমাদের গর্বের বাহিনী ধ্বংস হলো। ক্ষমতায় যাওয়ার শেষ সিড়ি হিসেবে এদের ব্যবহার করে চক্রান্ত করে ধ্বংস করে দিলো। বাহিনীর নাম বদলে বিজিবি রাখা হয়েছে। আগে নাম ছিল বাংলাদেশ রাইফেলস। আর এখন নাম দিয়েছে বর্ডারের চৌকিদার। লগো বদলিয়েছে, ড্রেস পালটিয়েছে, নাম বদলিয়ে ফেলেছে। কারা হত্যাকারী ছিল জাতিকে জানতে দেওয়া হলো না। লুকোচুরি করা হলো। রাতের অন্ধকারে বিদ্যুতের আলো কেড়ে নিয়ে, অন্ধকার করে খুনিদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলো। আমরা সেই হত্যাকাÐের বিচার চাই।
তিনি বলেন, এরপর শুরু হলো তাদের তান্ডব। তাদের প্রথম লক্ষ্যবস্তু করলো জামায়াতে ইসলামীকে; যারা পরিক্ষীত দেশপ্রেমিক। তারা তাদের সততায় দেশবাসীকে মুগ্ধ করেছিল। দক্ষতার সাক্ষর রেখেছিলেন। দায়িত্বের পরতে পরতে সেই সমস্ত নেতৃবৃন্দকে ঠান্ডা মাথায়, মিথ্যা অভিযোগ সাজানো কোর্ট, পাতানো সাক্ষী এবং ব্রাসেলস থেকে রায় এনে সেই সমস্ত নেতৃবৃন্দকে খুন করা হলো, ফাঁসি দেওয়া হলো, কাউকে কাউকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হলো, জেলের ভেতর মৃত্যু করলেন।
তিনি উল্লেখ করেন, আজকে যুবকরা বলতেছে আমাদের ভোট চুরি করেছিল। তিনটা নির্বাচন আজ যাদের বয়স ৩০-৩২ বছর; তারা একটা ভোটও দিতে পারেনি। তাদের সমস্ত ভোটকে জেনোসাইড করেছিল, গণহত্যা করেছিল। ভোটের গণহত্যা। এদের নৈতিক সাহস ছিল না দেশে থাকার। এজন্য দেশ থেকে পালিয়ে গেছে।
তিনি ভারতের উদ্দেশ্যে বলেন, প্রতিদেশী দেশকে বলতে চাই — আপনারা শান্তিতে থাকেন। আমাদেরকেও শান্তিতে থাকতে দেন। আপনাদের পাক ঘরে কি পাকাবেন আমরা জিজ্ঞেস করি না। আমাদের পাক ঘরে উঁকি মারার চেষ্টা করবেন না। নিজেরা আয়নায় চেহারা দেখুন। আমাদের সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির সবক দিতে হবে না।
জামায়াতে ইসলামীর আমির উল্লেখ করেন, যেখানে আমাদের শীর্ষ ১১ নেতাকে খুন করা হয়েছে, সবগুলো অফিস তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, আমাদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যেখানে নিবন্ধন কেড়ে নেওয়া হয়েছে, বেদিশা হয়ে শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ পর্যন্ত করা হয়েছে। এতে যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বলেছি দেশ আমরা ভালবাসি, মানুষকে আমরা ভালবাসি।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন চাইলে আমরা কিছু কিছু চাঁদাবাজি করতে পারতাম। কিছু দখল নিতে পারতাম। কিন্তু এটা আমাদের জন্য হারাম মনে করি। প্রিয় বাংলাদশে গড়তে জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের আরও ধৈর্য্যরে পরিচয় দিতে হবে? আমরা একটা সাম্যের বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। বৈষম্যকে নির্বাসনে পাঠাবো। আমরা মেধার স্বীকৃতি প্রদান করবো, পলিটক্রেসি নয় মেরিটক্রেসির ভিত্তিতে জাতি গঠন করবো। যুবকদেরকে শিক্ষা দিয়ে বেকারের হাত বাড়াবো না, যুবকদের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করবো।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মৌলভীবাজার জেলায় কোন ভাল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং এগ্রিকালচার বিশ্ববিদ্যালয় নেই। কেন? মৌলভীবাজার কি অপরাধ করেছে?
তিনি বলেন বাংলাদেশ মৌলভীবাজারে সবচেয়ে বেশি চা বাগান। রাষ্ট্রীয় যথাযথ পর্যবেক্ষণ না থাকায় চা শিল্প ধ্বংস হওয়ার পথে। মালিকপক্ষ চায়ের যথাযথ মূল্য পান না। শ্রমিকরাও পারিশ্রমিক পান না। তিনি নেতাকর্মীদের চারটি বিষয় তুলে ধরেন এর মধ্যে নিয়ত সহি করে জ্ঞানের রাজ্যে এগিয়ে গিয়ে সাহসী হয়ে কঠোর পরিশ্রম করার আহŸান করেন। সব শেষ তিনি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহŸান জানান।
জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় গেলে কোন পরাশক্তি দেশের প্রতি চোখ রাঙ্গাতে পারবে না। আর কোন ফেলানীর লাশ কাঁটাতারে ঝুলবে না। সবাই স্বাধীনভাবে তার কর্মকান্ড পরিচালনা করতে পারবে ইনশাআল্লাহ। সমাবেশ শেষে জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমান মৌলভীবাজার জেলার বিশিষ্টজন, সুধী ও পেশাজীবি সহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের সাথে স্থানীয় একটি হোটেলে মতবিনিময় করেন।