মেজবাহ উদ্দিন সাঈদ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বতী সরকার দায়িত্ব নেয়। গত ১৬ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের একশ’ দিন অতিবাহিত হয়েছে। সেই হিসেবে ‘হানিমুন পিরিয়ড’ পেরিয়ে এখন দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়েছে সরকার। অবশ্যি ১০০ দিন উপলক্ষে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যধারা, অর্জন ও আশু কর্মপরিকল্পনার তথ্য সম্প্রতি প্রকাশ করেছে অন্তর্র্বতী সরকার। সেখানে কেবলই সাফল্যের বয়ান। তবে বাস্তবতার নিরিখে জনগণ তার কতটুকু সুফল ভোগ করছে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
বহুল প্রচলিত ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে-‘মর্নিং শো’জ দ্যা ডে’। অর্থাৎ সকালেই দিন বোঝা যায়। সেই নিরিখে সরকারের একশ’ দিনের মেয়াদকালে জনগণ আশ্বস্ত হবার কোনো সূত্র খুঁজে পায়নি। বরং মোটা দাগে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী বলে প্রতীয়মান হয়। খাত ওয়ারী বিশ্লেষণেও সেটির প্রমাণ মিলবে। সবচে’ বড় কথা রক্তাক্ত জুলাই-আগস্টে যাদের আত্মত্যাগে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, কিংবা বলা যায় নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু- সেসব বীর এবং তাদের স্বজনদের আহাজারি সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যমে দাবি করা হয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অন্তত দেড় হাজার নিহত এবং ৩০ হাজার ছাত্র-জনতা নানাভাবে আহত হয়েছেন (যদিও তিন মাসে সঠিক পরিসংখ্যান বের করা সম্ভব হয়নি)। হতাহতদের পরিবারকে সহায়তায় সরকার বহু আগেই একশ কোটি টাকার তহবিল করেছেন বলে প্রচার রয়েছে। একইভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে অর্থ সংগ্রহ হয়েছে। সেখান থেকে শহিদ পরিবারকে পালাক্রমে আর্থিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। তবে তার গতি ধীর। অন্যদিকে আহতদের সম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যয় সরকার বহন করবে বলে ঘোষণা আছে। উপরন্তু আহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার কথাও মাঝে মধ্যে শোনা যায়। তাছাড়া গুরুতর কয়েকজনকে উন্নত চিকিৎসায় রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে বিদেশেও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতা এবং যথাযথ তদারকির অভাবে আহতদের চিকিৎসা প্রদান নিয়ে যে নৈরাজ্য চলছে তা গোপন কোনো বিষয় নয়। সোমবার (১৮ নভেম্বর) সহযোগী একটি দৈনিকের প্রথম পাতায় “আহতদের অনেকেই পাননি সরকারি অর্থ, নিঃস্ব পরিবার” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। যেখানে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরস্থ পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একাধিক আহতের দুর্দশার সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, “আহত রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন পরিবারের সদস্যরা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হাসপাতালে পরে থাকায় ধার-দেনার পাশাপাশি শেষ সম্বল ভিটের জমি পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছেন অনেকে।” প্রতিবেদন ভাষ্যে রোগীদের ওষুধ-পত্র, চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার সম্পূর্ণ বিনামূল্যে হাসপাতালের পক্ষ থেকে দেয়া হলেও তাদের দেখভালের জন্য থাকা স্বজনদের নিত্যকার ব্যয় মোটানোর কোনো সংস্থান নেই। ফলে আহতদের পরিবারগুলো কি মানবেতর জীবন যাপন করছে, তা সহজেই অনুমেয়।
এর আগে গত ১৩ নভেম্বর পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে আহতদের রোষাণলে পড়েছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। সেদিন ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুককে নিয়ে হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। আহতরা সেদিন ওয়ার্ড ছেড়ে হাসাপাতাল চত্বরে নেমে উপদেষ্টার গাড়ি আটকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। উপায়ান্তর না পেয়ে উপদেষ্টা অন্য গাড়িতে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। এতে আহতরা আরো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা পরে হাসপাতাল সংলগ্ন সড়কে অবস্থান নেন। পরে গভীর রাতে চারজন উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার একজন সহকারী সেখানে গিয়ে আহতদের সঙ্গে কথা বলেন ও অভিযোগ শোনেন। একই সঙ্গে ভুল স্বীকার ও দুঃখ প্রকাশ করেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পরের দিনই আহত ব্যক্তিদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সচিবালয়ে বৈঠক করেন। পাশাপাশি আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য একটি রূপরেখা তৈরি করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তা বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন।
ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, আহত হওয়া ব্যক্তিদের ক্ষোভ-বিক্ষোভের সূত্রপাত স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শনকে কেন্দ্র করে। কেননা, চিকিৎসাসেবা নিয়ে তাদের নানা অভিযোগ ছিল। এসব বিহিতের জন্য স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সাক্ষাত চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু উপদেষ্টা সেটি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করায় তাদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যাদের আত্মত্যাগে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন-তাদের প্রতি কেন উদাসীনতা। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যেখানে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে সুষ্ঠু চিকিৎসা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ, সেখানে মফস্বল কিংবা জেলা শহরগুলোর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতরা কি অবস্থায় আছেন তা যাচাইয়ের অবকাশ নেই। বলা যায়, কান পাতলে সর্বত্রই দায়িত্বহীনতার শোর শোনা যাবে।
সরকারের আরেকটি বড় ব্যর্থতা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। এটির প্রভাবে প্রতিটি মানুষ প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছেন। যদিও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। কিছু কিছু নিত্য পণ্যের শুল্ক কমানো কিংবা প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু বাজারে স্বস্তি ফেরেনি; বরং বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম আরও বেড়েছে। চাল, ডাল, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, আলু, ব্রয়লার মুরগি এমনকি তরিতরকারিÑসব কিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। এসবের নেপথ্যে বরাবরের ন্যায় সিন্ডিকেটের কারসাজির অভিযোগ থাকলেও সেটি ভাঙ্গা যাচ্ছে না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ, যা গত তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্যমূল্য স্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির পণ্য কিনতে মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখা যাচ্ছে। বাজার কারসাজির জন্য অনেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ এক কর্মকর্তার দিকে আঙ্গুল তুলছেন। ওই কর্মকর্তা পতিত সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী আহসানুল হক টিটুর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
ব্যর্থতার কাতারে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ব্যাপক হতাহতের নেপথ্যে পুলিশ বাহিনীর অত্যুৎসাহী কতিপয় সদস্যের নৃশংসতাকে দায়ী করা হয়। সঙ্গত কারণে হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সদস্য এবং তাদের স্থাপনা জন আক্রোশের শিকার হয়। এতে করে পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। নতুন সরকার ব্যাপক প্রশাসনিক রদবদল করলেও এখন পর্যন্ত পুলিশ বাহিনী পূর্ণ মাত্রায় সচল হয়নি। ফলে অপরাধমূলক কর্মকান্ড বেড়ে যায়। চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি অহরহ ঘটে চলেছে। এরই মধ্যে রাজধানীতে একটি ডাকাতির ঘটনায় চাকুরিচ্যুত একাধিক সেনা কর্মকর্তা এমনকি পুলিশের একজন এডিশনাল এসপির জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। এ অবস্থায় পুলিশকে সহায়তা দিতে সেনাবাহিনী মাঠে রাখা হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীকে দুই মাসের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয় অন্তর্র্বতী সরকার। এই সময়ে সেনাকর্মকর্তারা গ্রেপ্তারের আদেশ জারি ও তল্লাশি পরোয়ানা কার্যকর করা এবং বেআইনি সমাবেশ করতে না দেওয়ার মতো বিভিন্ন ক্ষমতা দেওয়া হয়। গত ১৭ নভেম্বর সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আরো দুই মাস বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এরপরও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ছেদ রয়ে গেছে। সরকারের জন্য আরেকটি বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে যানজট। বলা যায়, এ সমস্যা এখন নগরবাসীর জন্য নিত্যকার হয়ে পড়েছে। অথচ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বেশ কয়েকবার এটি নিরসনের আশ্বাস দিয়েছেন। এমনকি রাজধানীর যানজটের অন্যতম কারণ ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান নিয়ন্ত্রণের কথা বলার পরও সে ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই।
প্রশাসনের ক্ষেত্রেও একই রকমের চ্যালেঞ্জের মুখে অন্তর্র্বতী সরকার। বিভিন্ন উদ্যোগের পর এখনো ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগীরা প্রশাসনের নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকায় অন্তর্বতী সরকারের কার্যক্রম কিভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়ে সন্ধিহান। সর্ষেতে ভুত থাকায় উল্টো লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছে। শুরুতেই জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদায়ন নিয়ে বড় ধরনের কেলেংকারির ঘটনা ঘটে। দুই দফায় ৫৯ জন ডিসি নিয়োগ দেয়ার পর দেখা গেছে, নিয়োগপ্রাপ্তদের সিংহভাগই ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগী। এমনকি কারো কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এসব নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে পত্রিকান্তরে সংবাদ প্রকাশ হয়। বিষয়টি তদন্তে একাধিক উপদেষ্টাকে নিয়ে কমিটিও হয়েছিল। পরে সরকারের পক্ষ থেকে উত্থাপিত অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করা হলেও সুবিধাভোগীরা কিভাবে নিয়োগ পেলেন তার ব্যাখ্যা অজানাই থেকে গেছে। এদিকে নারায়ণগঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলায় এখনো সুবিধাভোগী বহাল আছেন। অন্যদিকে রক্তাক্ত জুলাইয়ে ঢাকার ডিসি হিসেবে দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তাকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পদায়ন করে পুরস্কৃত করা হয়েছে। অথচ জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় এই দু’জন ডিসির প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। সর্বোপরি প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর অংশ হিসেবে অন্তর্র্বতী সরকার অনেক রদবদল করেছেন। পাশাপাশি আওয়ামী সরকারের আজ্ঞাবহদের সরিয়ে ১৫ বছর ধরে বঞ্চিত মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি এবং পদায়নের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ প্রক্রিয়ায় কর্মরত অনেককে একদিকে ডাবল-ট্রিপল পদোন্নতি দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে ১০-১২ বছর আগে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাকে ডেকে এনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এতে করে হিতে বিপরীত অবস্থা তৈরি হয়েছে। এখানেও বৈষম্যের অভিযোগ রয়েছে। এটিকে অনেকে বয়স্ক পুনর্বাসন হিসেবে দেখছেন। এর ফলে কাজের গতি যেমন থমকে যাবার আশংকা থাকে, তেমনি বঞ্চিতদের মধ্যে পদোন্নতি বঞ্চনার ক্ষোভ তৈরি করছে। সবচে’ বড় কথা স্থানীয় সরকারসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় চলছে সচিববিহীন। গত তিন মাসেও সরকার ‘সচিব যোগ্য’ কাউকে খুঁজে পাননি।
এদিকে সরকারের উপদেষ্টা কারো কারো ভূমিকা এবং বচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তাপের পারদ বাড়ছে। এমনকি, ১০০ দিন উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে বহু বিষয়ের সমাহার থাকলেও জনগণের প্রত্যক্ষ সমস্যা সমাধানে দিগনির্দেশনা মিলেনি। সব মিলিয়ে সরকারের যাত্রা আনন্দময় হলেও দিনকে দিন সেটি ফিকে হয়ে আসছে। বলা যায়, বিষাদের কালো মেঘ ছেয়ে আসছে। যার পরিণতি শুধু সরকারকে বিব্রত করবে না, দেশকেও এক সংকটময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিবে। অতএব সাধু সাবধান!