এ বি সিদ্দিক
মামা,
আপনি আমার জীবনের এক অন্যরকম অনুভূতি, মধুর স্মৃতি, প্রাণের আকুতি, মনের মিনতি, সৃষ্টির মহা ইতিহাস। আসলে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে বলতে হয়,
মনটা যদি খোলা যেত সিন্দুকেরই মতো,
দেখাইতে পারিতাম মামা তোমায় ভালোবাসি কতো?
ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারিনা, ইচ্ছা থাকলেও লেখা থেকে বিরত থাকতে পারি না। কারণ একটাই, তা হলো আপনি এবং আপনার নির্ভেজাল ভালোবাসা। আমার আবেগী মনের বিবেকী সংলাপগুলো আপনার মনের সিন্দুকে মালা গাঁথার মতো সাজিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যা লোহার সিন্দুকে রাখার চেয়েও অনেক নিরাপদ এবং ঝুঁকিমুক্ত। কোন ভূমিকম্প এতে কোন কম্পন ধরাতে পারবেনা। কারণ কঠোর নিরাপত্তার ভেতরেও শাহজালাল বিমান বন্দরের শুল্ক বিভাগের সিন্দুক থেকে ৫৫ কেজি স্বর্ণ গায়েব, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভোল্টের ৯৬৩ কেজি সোনা তামা হয়ে যায়। তা হলে আপনি ছাড়া ভরসা বা নিরাপত্তা কোথায়? আপনি হলেন বিবেকের সান্ত্বনা এবং ঝুঁকিমুক্ত।
বিজ্ঞজনদের মতে,
সাঁতার দিয়ে নদী পার হওয়া যায়
কিন্তু সাগর নয়
মাটি দিয়ে পুতুল বানানো যায়
মানুষ নয়।
টাকা দিয়ে গাড়ি বাড়ী কেনা যায়
কিন্তু মন নয়
যুদ্ধ করে বিশ্বজয় করা যায়
কিন্তু ভালোবাসা নয়।
আমি আর ডামি নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা যায়
কিন্তু জনগণের আস্থা অর্জন নয়।
মামা,
আপনি আমার কাছে তপ্ত মরুভূমির আরাফাত ময়দানের নিম গাছের শীতল ছায়া। ধৈর্য ও সাহসিকতার সাথে স্বার্থান্বেষী মহলের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিবেকের তাড়নায় বাস্তবতার আলোকে নিখুত বিশ্লেষণ পূর্বক আমার কথাগুলো শ্রবণ ও হৃদয়ঙ্গম করে আসছেন বহুদিন থেকে বিরামহীনভাবে। দুর্বার গতিতে বুদ্ধিদীপ্ত তারুণ্যের মাঝে আমার চিঠিটি আলোচনায় নিয়ে এসেছেন। এতে পাঠকের কৌতূহল বেড়েছে। যদিও আমেরিকার দেওয়া সেই স্যাংশনের মত আমার উপর পাঠকের চাপ, যা কোন মতে এড়াতে পারছি না। মন না চাইলেও লিখতে বাধ্য হচ্ছি। তারপরও আপনাকে অন্তহীন ভালোবাসা এবং গভীর শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা জানাই। সব আল্লাহর ইচ্ছে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের রোমিও জুলিয়েটের প্রেমকাহিনী এবং চাকমাদের অমর প্রেম গাঁথা রাধামন- ধনপুদির পালার মতো শ্রুতি ও স্মৃতিতে ভাগিনার খোলা চিঠি পাঠকের অন্তরে, গবেষকদের গবেষণায় এবং ইতিহাসবিদদের ইতিহাস চর্চার জন্য একটি বিশেষ অভিধান হয়ে উঠবে। এতে আগামী প্রজন্ম অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নতুনভাবে জানতে পারবে। সমৃদ্ধ হবে তাদের জ্ঞান ভান্ডার।
মামা,
অগণিত পাঠকের আশীর্বাদ আর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা নিয়ে চিঠিটি ১৬ পর্বে অবতীর্ণ। জীবন ও যৌবনের টার্নিং পয়েন্ট ষোল। এ সময়টা স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল। এ বয়স কে লক্ষ্য করে কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন,
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়।
এ কবিতাটি হেলাল হাফিজ কে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে আবার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। গুরুত্বপূর্ণ ১৬ সংখ্যাটি আমাদের আশেপাশের অনেক কিছুকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৫৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কিউবার বিদ্রোহী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কিউবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুর বাংলাদেশ কে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতিদান করে। ষোড়শ শতাব্দীতে এ দেশে ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাণিজ্যের নামে পাক-ভারতে এসে পরবর্তীতে আধিপত্য বিস্তার করে। ২০০ বছর পাক-ভারত শাসন ও শোষণ করে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভাগীরতীর তীরে পলাশীর আম্রকাননে একজন বিশ্বাসঘাতকের বদৌলতে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার জননন্দিত নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যটি অস্তমিত হয়। ইংরেজরা পুরো ভারত বর্ষকে তাদের অধীনে নিয়ে যায়।
১৬ সংখ্যা নিয়ে কবি সুকুমার রায় জীবনের হিসাব কবিতাটির ইতি টানেন। নদীতে প্রচন্ড ঝড় তুফান, মূর্খ মাঝি বাবুকে জিজ্ঞাসা করল,
“সাঁতার জান বাবু?”
বাবু বললেন, “নারে বাপু না”। মাঝি বললেন, “এখন কেন কাবু?”
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসাব করো পিছে
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে।
মানুষ কথায় কথায় বলে, জীবনটা দেখি তোর ষোল কলায় পূর্ণ হলো।
আবার ১৬ ডিসেম্বর আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় দিন। এ দিন আমাদের বিজয় দিবস।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়া বাংগালী দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয়ের দেখা পায়। ১৬ ডিসেম্বর ঐ দিনের সকাল ছিল শত বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেংগে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার সূচনা।
১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে [ বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ] পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রায় ৯১, ৬৩৪ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণ দলিলে সই করেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্ববাংলার কমান্ডার অধিনায়ক এ.এ.কে নিয়াজী। পাশে বসা ছিল মিত্র বাহিনীর লে. জেনারেল জগৎ সিং আরোরা। বাংলাদেশের ও ভারতের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। সেদিন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম.এ.জি ওসমানি অনুপস্থিত ছিলেন। ঐদিন এম.এ.জি ওসমানী ও জাফরুল্লাহ চৌধুরী সহ আগরতলা থেকে সিলেটগামী হেলিকপ্টারটি নীচের জমিন থেকে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। হবিগঞ্জের ধান ক্ষেত থেকে বিধ্বস্ত হেলিকপ্টার থেকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় দু’ জনকে। ঐ ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে তার অনুপস্থিতি অনেকের কাছে প্রশ্ন।
মামা,
মোমবাতির সুতাটা মোমবাতিকে জিজ্ঞাসা করল, “জ্বলছি তো আমি তুমি কাঁদছ কেন?” মোমবাতি বলল, “যাকে হৃদয়ে জায়গা দিয়েছি সে যদি জ্বলে যায় বা নিঃশেষ হয়ে যায় তাহলে তো অশ্রু ঝরবেই। “সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ চোখের জলে বুক ভাসিয়ে ফেলে। এরশাদ হতবাক হয়ে কাজী জাফরকে জিজ্ঞেস করল, “মা মারা গেল আমার, তুমি এত কাঁদছো কেন?” উত্তরে কাজী জাফর বলল, “স্যার আপনাকে আমার হৃদয়ে আসন দিয়েছি আপনার চোখে জল আসলে আমি আমার চোখের জল ধরে রাখতে পারি না”।
এ হলো এ দেশের একজন প্রধানমন্ত্রী আর রাজনীতির হাল চাল। এ দেশে রাজনীতির নামে চলে ধোকাবাজি আর চরম তোষামোদি, যা বর্ণমালায় বর্ণনা করা অসম্ভব হয়ে উঠে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানের ভাষায়, এদেশে গুণগত রাজনীতির কোন চর্চা নেই। নেই পরমত সহিষ্ণুতা। যে যখন ক্ষমতায় যায় তখন ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মনে করে। অথচ হিটলার ও মুসোলিনিকেও ক্ষমতা হারাতে হয়েছে। সময় অসময়ে রাজনীতি জনগণের কাছে বিভীষিকাময় হয়ে উঠে। শাসক গোষ্ঠীর স্বৈরাচারী কর্মকান্ডে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। এরশাদ স্বৈরাচারী কায়দায় ৯ বছর দেশ শাসন করে। গণতন্ত্রের নামে দেশকে রসাতলে নিয়েছে, নষ্ট করেছে এদেশের রাজনীতি। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ডঃ হুমায়ুন আজাদের ভাষায়, এরশাদ ছিল চরম নষ্ট এক নায়ক, সে পেয়েছিল সমানে সমান নষ্ট এক সহধর্মিণীকে, সংগ্রহ করেছিল অসংখ্য নষ্ট নারী এবং অজস্র নষ্ট দাস। এরশাদ দূষিত করে গেছে এমন কি নারী ও কবিতাকে। সে বাংলাদেশের চরিত্রটিকেই দূষিত করে গেছে। বাংলাদেশে একটি সৎ মানুষ পাওয়াই দুর্লভ হয়ে উঠেছে। অত্যাচার ও চরিত্রহীনতায় সে ছিল অতুলনীয়। শিল্পী কামরুল হাসান তাকে বলে গেছেন বিশ্ব বেহায়া, এ নামও সম্ভবত তার জন্য প্রশংসা। কোন শব্দই তার স্বৈরাচার, ভন্ডামো, দুর্নীতি, চরিত্রহীনতাকে প্রকাশ করতে পারেনা।
সেই এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টির এখন তার ভাই জিএম কাদেরের নেতৃত্বে চলছে। জাতীয় পার্টি এ দেশের রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক হিসাবে আছে। কখনও বিরোধী দলে, কখনও জোট সরকারের ক্ষমতার অংশীদার। অনেকের ভাষায় গৃহপালিত বিরোধী দল। মাঝে মাঝে সরকারের বিরুদ্ধে দু একটি কথা বলে পত্রিকার হেডিং হয় এবং নিজের অবস্থানকে নাড়াচাড়া দেয়। ভারত সফরের পর জিএম কাদের মুখ খুলেনি। ওরা না বললে কিছুই বলতে পারবেনা এ ছিল তার অবস্থান। দেশের জনগণের ভোটাধিকার ও মানবাধিকার আছে কি নেই এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়েও তাদের কোন চিন্তা ভাবনা নেই। বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড, গুম ও খুন নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। এদের উদ্দেশ্য হলো, তারা যে স্বৈরাচার ছিল তার থেকে আরো বেশী স্বৈরাচার বানানোর জন্য সরকারের উপর সওয়ার হয়ে কাজ করছে এবং সংসদের আসন, মন্ত্রিত্বের ভাগ নিয়ে বেশ সুযোগ সুবিধা নিচ্ছে। লজ্জাহীনভাবে কথাবার্তা বলে রাজনীতির দাবার গুঁটি হিসাবে খেলে যাচ্ছে এবং রাজনীতিকে কলুষিত করেছে।
সরকারের উপর নানাভাবে চাপ দিয়ে কূট কৌশল করে ফায়দা লুটে নিচ্ছে।
চিল যতই উপরে উঠুক নজর কিন্তু নিচের দিকেই। মন্দ লোকের স্বভাব কখন ও পরিবর্তন হয়না। কথায় বলে,
ঘি দিয়ে ভাজা নিমের পাতা
তবু ও না যায় জাতের তিতা।
মামা,
প্রাইমারী স্কুলের ৫ম শ্রেণীতে কবি গুরু রবি ঠাকুরের সামান্য ক্ষতি কবিতাটি পড়েছিলাম। কবিতাটির সারমর্ম হলো যে, রাণী মাঘের শীতের সকালে নদীতে স্নান শেষে কনকনে শীতের সুখানুভূতির জন্য সাথে থাকা সখীদের নির্দেশ দিলেন আগুনের ব্যবস্থা করার জন্য। কাঠ, খড়, কুটা না কুড়িয়ে প্রজাদের জীর্ণ কুটিরে (কুড়েঘর) আগুন ধরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিল। নির্দেশ মত সখীগন অসহায় গরিব প্রজাদের জীর্ণ কুটিরে আগুন ধরিয়ে দিল। মুহুর্তের মধ্যে জীর্ণ কুটির গুলো জ্বলে পুড়ে ছারখার। রাণী যথারীতি তপ্ত শরীর নিয়ে আনন্দ চিত্তে রাজপ্রসাদে ফিরে গেল। এ দিকে গৃহ হারা গরীব প্রজারা দলে দলে রাজপ্রসাদে এসে অনুনয় বিনয় করে তাদের ক্ষতির বিষয়টি রাজা মহাশয় কে জানালেন। ঘটনা জানার সাথে সাথে রাজা রাণীকে কৈফিয়ত তলব করলেন। রাণী বিষয়টিকে তাচ্ছিল্য ভাব দেখালেন এবং সামান্য ক্ষতি মনে করলেন। রাণীর সদুত্তর না পেয়ে রাজা কহিলেন,
মাগিবে দুয়ারে দুয়ারে
এক প্রহরের লীলায় তোমার
যে ক’টি কুটীর হল” ছারখার
যতদিনে পারো সে ক’টি আবার
গড়ি দিতে হবে তোমারে।
রাজার আদেশে কিংকরী আসি
ভূষন ফেলিল খুলিয়া
অরুণ বরূন অম্বর খানি
নির্মম করে খুলে নিল টানি
ভিখারী নারীর চিরবাস আনি
দিল রাণীর দেহে তুলিয়া।
বর্তমান বিশ্বে শাসকদের এ রকম প্রজাপ্রীতি বিচার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আমাদের দেশে অপরাধীরা অপরাধ করে যাচ্ছে, দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করছে, কোটি কোটি ডলার পাচার করে দেশকে দেউলিয়া বানাচ্ছে। কুইক রেন্টাল আর মেগা প্রজক্টের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ভরছে সুইস ব্যাংকে, তা ও এ টাকা এ দেশে আসবেনা। লুটেরা গোষ্ঠী কোটি কোটি টাকার গাড়িতে চড়ে লাখো টাকার জামা পরিধান করে হাজার হাজার ডলারের পারফিউম গায়ে মেখে মদের বার আর জুয়ার আড্ডা এবং ডিস্কোতে নিজেদের মাতিয়ে রাখছে সারাক্ষণ। সহজ শর্তে কেউ ৯০ হাজার কোটি টাকা ঋণ, কেউ আবার ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করছে বা অবৈধ কাজে ব্যবহার করছে। শোষিত হচ্ছে গরীব অসহায় জনগণ। প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করতে গেলে উল্টো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হচ্ছে এ হলো আমাদের অবস্থা। তনু হত্যার বিচার হয়নি, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার আজ পর্যন্ত চার্জশিট দাখিল হয়নি। নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের মামলার রায়ের বাস্তবায়ন হয়নি। বুয়েটের আবরার হত্যার রায়ের বাস্তবায়ন অপেক্ষার প্রহর গুনতে হচ্ছে। অথচ গুম এবং খুন ও ছেলে হারা মায়ের করুণ আর্তনাদ শুনলে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠে। বঙ্গবন্ধু একজন নির্যাতিত নারীকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দিয়েছিলেন, যিনি নেপালের রাষ্ট্রদূত হিসাবে রিটায়ার্ড করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ওদের পিতার জায়গায় লিখে দাও শেখ মুজিবুর রহমান এবং ঠিকানার জায়গায় লিখে দাও ধানমন্ডির ৩২ নম্বর। আমরা কি সেই পিতার যোগ্য সন্তান হতে পেরেছি? আমরা কি মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর আদর্শকে ধারণ করতে পেরেছি?
মামা,
প্রখ্যাত সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল ৭১ এর ১৭ মে থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১১৬ পর্বের চরমপত্রটি পাঠ করেছিলেন। চরমপত্রে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে আঞ্চলিক ভাষায় মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গনের খবরা খবর, পাক সেনা ও রাজাকারদের দুষ্কর্মের নানা কাহিনী পরিবেশিত হতো। এম আর আখতার মুকুলের কন্ঠে মানুষ চা দোকান, হোটেল, রেষ্টুরেন্ট এমন কি কৃষক তার ক্ষেতের আইলে বা গাছ তলায় বসে স্বাধীনতা যুদ্ধের রঙ্গরসের কথাগুলো শুনতেন। এ চরমপত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও প্রেরণা যোগায়। একাত্তরের চরমপত্র রণাঙ্গণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। এর সাহিত্যমূল্য ঐতিহাসিক এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুক্তিযুদ্ধকালে বরেণ্য সাংবাদিক তোয়াব খানের “পিন্ডির প্রলাপ” অনুষ্ঠানটিও ছিল এদেশের মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার উৎস যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশ হিসাবে সুবিবেচিত। হানিফ সংকেত এর ইত্যাদি অনুষ্ঠানের নানা-নাতির রঙ্গরসের আলাপ, তোয়াব খানের পিন্ডির সংলাপ, গেদু চাচার খোলা চিঠি বা ভাগিনার খোলা চিঠি এমনকি ৭১ এর চরম পত্র আমাদের বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসাবে কল্পনা করা অমূলক হবে না।
মামা,
সুবেহ সাদিকের সময় আকাশের ক্লান্ত নক্ষত্রের মলিন মুখ আমাকে যেমন ব্যথিত করে তার চেয়ে বেশী ব্যথিত করে আপনার নিস্তব্ধতা। আপনার বিমুগ্ধতা হতাশ করে এবং চিন্তা মগ্ন হয়ে যাই, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ দেখে। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে, খাদ্যদ্রব্যে ১২ শতাংশেরও বেশী। নিত্য পণ্যের দাম আকাশ চুম্বী। মানুষের ক্ষোভ, হতাশা, দুঃখ-দুর্দশা অবর্ণনীয়। নীতি নির্ধারকেরা যদি বাজারে ছদ্মবেশে যান তা হলে শুনতে পারবেন সিদ্ধ ডিম ও কাঁচা মরিচের থেরাপী,, মিষ্টি কুমড়া দিয়ে বেগুনী, কম তেলের খাবার রান্না নিয়ে পাবলিকের অশালীন মন্তব্য। তখন কানে তুলো দিয়ে রাখতে হয়। কথাবার্তা গুলা “কুত্তার বাচ্চা ফুট ফুটে সুন্দর” গানটি থেকেও রুচিহীন মনে হয়। সিন্ডিকেট দোহাই আর চেতনার বুলি মানুষ এখন অস্বস্তিকর মনে করে। দ্রব্যমূল্যেই যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে তা হলে এতো আমলা কামলা পোষার দরকার কি?
শিল্পপতিরা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করছে অথচ উদ্ধারের কোন ব্যবস্থা নেই। তলে তলে কিন্তু দেশ রসাতলে যাচ্ছে কোন খবর নেই, ব্যাংকগুলো খালি হতে চলেছে। ১৫ টি ব্যাংক বিশেষ নজরে আছে। ঝুকিপূর্ণ খাতে ঋণ দিয়ে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে ১২ টি ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংক কে সবল ব্যাংককের সাথে একত্রিত করে ডায়ালোসিস করার চেষ্টা চলছে, তবে ফলাফল আশানুরূপ নয়। হিতে বিপরীত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। গত ১৪ বছরে খেলাপী ঋণ বেড়েছে ৭ গুণ। বর্তমানে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের ১০.১১ শতাংশ।
উত্তরণের পথ খুঁজছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ভুল তথ্য পরিবেশন বা আসল তথ্য ধামাচাপা দেয়ার জন্য এই দুরবস্থা। রবি ঠাকুরের ‘’জুতা আবিষ্কার’’ কবিতার মতো দেশের পন্ডিত বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের থেকে পরামর্শ নেয়া হচ্ছে। শুনতে অবাক লাগে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের বিচার হয়না অথচ বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার ছাগলের মালিকের ২০০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। উপজেলা অফিসের ফুলের চারা নষ্ট করার কারণে এ জরিমানা। মালিক ছাগলটি কসাইয়ের কাছে বিক্রি করে জরিমানা শোধ করে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও মানুষের নাগরিক অধিকার নেই, কথা বলার স্বাধীনতা নেই, ভোটাধিকার নেই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী খাদিজাতুল কুবরা জেলখানায় বিনা বিচারে ১ বছর ৯০ দিন ছিল। টক শো উপস্থাপনায় তার কিছু কথা সরকারের বিরুদ্ধে যায় এ অপরাধে তার এ শাস্তি। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনসহ বিশ্বের মানবধিকার সংগঠনগুলোর চাপের পরও শুধু নাম বদলে সাজা ও জরিমানা কমিয়ে বাড়িয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কে সাইবার নিরাপত্তা আইন নাম দেওয়া হয়। অর্থাৎ, নতুন বোতলে পুরাতন মদ।
ইতোমধ্যে দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেলো। এ নির্বাচনে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার দুই শত ৭৬ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে ব্যয় ছিল ৭০০ কোটি টাকা, ২০১৪ সালে ৩০০ কোটি টাকা, ২০০৮ সালে ২০০ কোট টাকা মাত্র। ১৫ বছরের ব্যবধানে নির্বাচনের খরচ ১০ গুন বেশী বাড়লেও নির্বাচনের মান উন্নত না হয়ে বহুগুণে নিম্নমুখী হয়েছে। এবারের নির্বাচনের নাম হয়েছে, আমি আর ডামি মডেলের নির্বাচন। যার ফলাফল হলো সংসদে বিরোধী দল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সরকারকে নির্ধারণ করে দিতে হচ্ছে। বিরোধী দলের আসন এবং অবস্থান সরকারের দয়া মায়ার উপর নির্ভর। অরাজনৈতিক সংগঠন ট্রান্সপারেসি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টি আই বি) এর ভাষায় অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষহীন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী, একই দলের স্বতন্ত্র ও অন্যদলের সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের পাতানো খেলা। ২৯৯ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে এক হিসাবে ২৮০ অন্য হিসাব ২৮২ জন আওয়ামীলীগ নেতা। বিরোধী দলে যারা আছেন তারাও আওয়ামীলীগের ছাড় দেয়া আসনের প্রতিনিধি। ইত্তেফাকের ভাষায়, “অন্যরকম এক সংসদের যাত্রা শুরু”। মানব জমিনের ভাষায়, আজব কিসিমের পার্লামেন্ট। অথচ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ অধিবেশনের প্রথম দিনেই বিশ্বের ৮০ টি দেশের ক‚টনীতিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের সমর্থন ও অভিনন্দন জানায়। আসলে বিচিত্র অভিজ্ঞতা কথা কম বলাই ভাল। আমরা চুনোপুটি। বর্তমানে দেশের বিরোধী দলের কোন সাড়া শব্দ নেই। তারা নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার। হাজার হাজার নেতা কর্মী কারাগারে, কালো পতাকার মিছিল করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। নেতা কর্মীদের মধ্যে হতাশার চাপ, চেহারায় আকাশের কালো মেঘ, নেতৃত্ব শূন্য দেশের অধিক জন সমর্থন পুষ্ট বৃহৎ বিরোধী দল আজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। খেলায় আপাতত হেরে গেল। সুচিন্তিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সাহস ও মনোবল নিয়ে আগাতে না পারলে সামনের দিকে আগানো এ দলের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠবে। রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অনেক ঘাটতি। পূরণ না হলে বার বার হোচট খাবেই। জার্সি পরা অবস্থায় না খেলতে না পেরে মাঠ থেকে ফেরত আসতে হয়েছে। নেতৃত্বের প্রতি এখন অনাস্থার সুর বেজে উঠেছে। প্রতিপক্ষ দলের প্রাণ ভোমরা আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে বিরোধী দলের বারবার চরম পরাজয়। কর্মীরা হতাশ।
মামা,
দেশে প্রকট সমস্যা, অভাব, অভিযোগের অন্ত নাই, চিত্র-বিচিত্র ঘটনা, দুর্ঘটনা, নানা জল্পনা কল্পনা অভিনব কায়দায় প্রতারণা, ঘটনা দামা চাপা দেয়ার নানা ক‚টকৌশলে পাবলিক বোকা বনে যায়, সত্য, মিথ্যার বেড়াজালে মানুষ বিভ্রান্ত। কখনো হিরো আলমের উত্থান, কখনো ডাঃ এমরান এইচ সরকার কখনো বা রানা প্লাজায় রেশমাদের আবিষ্কার হয় আবার কোথায় বিলীন হয়ে যায় কার ইশারায় তা বুঝা বড় দায়। রাস্তায় যানজট, অর্থ সংকট, হাসপাতালের চিকিৎসা সংকট, বেকার সংকট সহ দেশের মানুষ আজ নানামুখী সংকটে। তারপর ও শাসক গোষ্ঠীর মুখে শুনা যায় কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া দেশ ভালোই চলছে, মানুষ মহা সুখে আছে। এ নিয়ে একটি কৌতুক পত্রিকায় পড়লাম,
কলকাতায় চাকরি করেন বাঙালি বাবু। থাকেন মেসে। বাড়ি গ্রামে। মাঝে মধ্যে বাড়ি যান। মাসে- দুই মাসে একবার। তো মাঝখানে বাবু বাড়ি যেতে পারেননি। বাড়ি থেকে লোক চলে এসেছে কলকাতায় মেসে। বাবু বললেন কী রে? তুই এতো সকাল সকাল। সারারাত জার্নি করে এসেছিস, ব্যাপার কী? খবর ভালো তো? বার্তাবাহক বলল, হ্যাঁ বাবু। কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া খবর সব ভালো।
কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা? কী বিচ্ছিন্ন ঘটনা?
তেমন কিছু নয় বাবু। ঘাবড়াবেন না। কোদালটা ভোঁতা হয়ে গেছে।
-কোদালটা ভোঁতা হয়েছে? কিভাবে?
-আপনার প্রিয় ঘোড়াটাকে আপনি বলেছিলেন মারা গেলে মাটিতে পুঁততে। তা ঘোড়াটা মরে গেল। আমি কোদাল নিয়ে চললাম পাথুরে জমিতে। গর্ত খুঁড়তে। গেল ভেঙে কোদাল।
-কিন্তু ঘোড়াটা স্বাস্থ্যবান ছিল। বয়সও তেমন নয়। মরল কী করে?
-আরে আপনার প্রিয় ফজলি আমের গাছটা ওর ওপরে পড়ল যে।
-সে কি। কিভাবে?
-ওই যে আমি আমগাছটা কুড়াল দিয়ে কাটতে গেলাম।
-তুই আমার প্রিয় আম গাছ কাটবি কেন?
-আপনার মা যে বলে রেখেছেন, তিনি মারা গেলে আগুন যেন ওই আমগাছের কাঠ দিয়েই হয়।
-মা আর নেই। কী বলিস। কী হয়েছিল।
-নাতির শোক সামলাতে পারবেন কী করে। কত আদরের নাতি ছিল তাঁর!
-কী বলিস। আমার বুকের মানিক আর নেই!
-কী করে বাঁচবে বলুন। দুগ্ধ পোষ্য শিশু। মায়ের দুধ বিনা কি বাঁচতে পারে!
-মানে! কী বলছিস।
-হ্যাঁ কি বলব! বউদি তো জমিদারের মাতাল ছেলেটার হাত ধরে ভেগে গেছে। দুধের শিশুটাকে কেউ এইভাবে ফেলে রেখে চলে যেতে পারে! সাত গ্রামে ছি ছি পড়ে গেছে।
এই হলো বিচ্ছিন্ন ঘটনার বিবরণ।
মামা,
জুম্মার দিন মসজিদের পেশ ইমাম বয়ান করতে গিয়ে বললেন, মোনাফেকের গুনাহ মাফ হয় না (তওবা ছাড়া)। মোনাফেকের আলামত হলো যে লোক মিথ্যা বলে, আমানত এর খেয়ানত করে এবং যে কথা দিয়ে কথা রাখেনা। এ কথা শুনে চিন্তিত কারণ ঘুম ভাঙ্গলে সকাল না ভাঙ্গলে পরকাল, চিন্তায় আছি পরকালে কি জবাব দেবো? মামা দোয়া করবেন।
ইতি,
আপনার ভাগিনা।
চলবে——