চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বাজারের ডিম বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান আল আমিন স্টোর। প্রতিদিন এখান থেকে পাইকারি বিক্রি করা হয় হাজার হাজার ডিম। সম্প্রতি চড়া বাজারকে কাজে লাগিয়ে কেনা দরের চেয়ে প্রতিটি ডিম এক থেকে দেড় টাকা বেশিতে বিক্রি করছে তারা। তবে বাড়তি দামে ডিম বিক্রি করলেও কেনাবেচার কোনো রসিদ বা ভাউচার নেই। অথচ দোকানের মালিকের বিরুদ্ধে বিক্রির দামের চেয়ে অনেক কম দরে হাজার হাজার পিস ডিম কেনার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
শুধু আল আমিন স্টোর নয়, পাহাড়তলী বাজারসহ চট্টগ্রামের আরও কিছু এলাকায় কয়েক গুণ বেশি দামে ডিম বিক্রি করে ভোক্তার পকেট কাটছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। কত টাকায় ডিম কেনা ও তা বিক্রি করা হচ্ছে, এ তথ্য গোপন করতে এই সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে ‘কাগজহীন কালো বাজার’। জেলা প্রশাসন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এই সিন্ডিকেটে জড়িত অন্তত ৩০ পাইকারি প্রতিষ্ঠান ও মধ্যস্বত্বভোগী। তাদের বিরুদ্ধে বাড়তি দামে ডিম বিক্রির প্রমাণ মিলেছে। দাম কারসাজির সঙ্গে শুধু চট্টগ্রাম নয়, বিভিন্ন স্থানের বড় কিছু আড়তদার, ব্যবসায়ী, খামারিও জড়িত।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, একটি ডিমের উৎপাদন খরচ পড়ে ১০ টাকার মতো। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক খরচ যোগ করলেও প্রতিটি ডিমের দাম সাড়ে ১০ টাকার বেশি হবে না। অথচ খুচরা পর্যায়ে সেই ডিম (লাল) কিনতে একজন ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ টাকা। চট্টগ্রাম নগরীতে খুচরা পর্যায়ে প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকায়।
অনুসন্ধান বলছে, চট্টগ্রাম নগরীর ১৫ উপজেলার বড় বাজারগুলোতে ডিমের চালানের একটি বড় অংশ আসে ঢাকার তেজগাঁও, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁওসহ কয়েকটি স্থান থেকে। স্থানীয় কিছু খামারিও বাজারে ডিম সরবরাহ করেন। অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পেছনে কারসাজির সঙ্গে জড়িত চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হলো– জিলানী স্টোর, রাজ এন্টারপ্রাইজ, আলম ব্রাদার্স, জনপ্রিয় স্টোর, নাসফিকা ট্রেডার্স, আল আমিন স্টোর, আমিন এন্টারপ্রাইজ, হালাল শপ, জান্নাত ট্রেডার্স ও জে এন ট্রেডার্স। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটিই ডিম কেনাবেচার বৈধ রসিদ সংরক্ষণ করেনি। ফলে জড়িতদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে ভোক্তা অধিকারসহ জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের।
পাহাড়তলীর আল আমিন স্টোর টাঙ্গাইলের ইয়াসিন ট্রেডার্স, মেসার্স মায়ের দোয়াসহ আরও কয়েকটি আড়ত থেকে কোনো রসিদ সংরক্ষণ না করেই পাইকারিভাবে হাজার হাজার পিস ডিম সংগ্রহ করেছে। দোকানটি প্রতি পিস ডিম ১১ থেকে ১২ টাকায় কিনে কারও কাছে ১৩ টাকা ৫০ পয়সা আবার ১৪ টাকার ওপরে বিক্রি করছে। বাড়তি এই দামে বিক্রির কোনো রসিদ তারা ক্রেতাকে দিচ্ছে না। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে দোকানের ব্যবস্থাপক মো. দিদার বলেন, সরবরাহকারীরা আমাদের রসিদ দেয় না। তাই আমরাও ক্রেতাকে রসিদ দিতে পারি না। সরবরাহকারীরা যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, তা থেকে সামান্য লাভে আমরা ডিম বিক্রি করছি।
কিছু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ডিম বিক্রির সময় দোকানদারদের খালি রসিদের পাতা দিচ্ছে। পরে উভয় পক্ষের লাভ নির্ধারণ করে দোকান মালিকরা খালি রসিদে নিজেদের ইচ্ছে মতো বেশি দাম বসিয়ে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাজারে সংকট দেখা দিলে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এই সিন্ডিকেট প্রতিটি ডিমের দামে সর্বনিম্ন ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকার বেশি বাড়িয়ে দেয়।
ডিমের দাম অস্বাভাবিক বাড়ার পেছনে কিছু মধ্যস্বত্বভোগী জড়িত বলে স্বীকার করেন চট্টগ্রাম ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম। তিনি বলেন, এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে বড় কিছু প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারী জড়িত। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আগে কারসাজির হোতাদের চিহ্নিত করতে হবে।
ক্যাবের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ডিমের দাম ডজনে ৩০ টাকার বেশি বেড়ে যাওয়া সিন্ডিকেটের কারসাজি ছাড়া কিছু নয়। বর্তমানে একটি ডিম কিনতে মানুষকে ১৪ থেকে ১৫ টাকা গুনতে হচ্ছে। এত টাকা দিয়ে ডিম কেনা গরিব ও অসহায় খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে অসম্ভব। ভোক্তাদের ঠকিয়ে নিজেদের পকেট ভরতে অসাধুরা কেনাবেচার রসিদ রাখছে না। প্রশাসনের তদারকির অভাবেই এমনটি হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নাসরিন আক্তার বলেন, ডিমের দাম নিয়ে কিছু অসাধু মধ্যস্বত্বভোগী অন্যরকম খেলায় মেতেছে। তারা কারসাজি করে দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। কেনা দরের চেয়ে কয়েক গুণ দামে ডিম বিক্রি করলেও এ-সংক্রান্ত কোনো রসিদ সংরক্ষণে রাখছে না তারা। অনেকে আবার খালি রসিদে নিজেদের ইচ্ছামতো দাম বসাচ্ছে। কারসাজিতে জড়িত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়েছে। চক্রের সঙ্গে কারা জড়িত, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ডিমের দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে নিজেদের পকেট ভরতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কাগজহীন কালো বাজার কৌশল নিয়েছে। এর প্রমাণ পেয়েছি আমরা। কম দরে ডিম কিনে বাড়তি দামে যারা বিক্রি করছে, তাদের চিহ্নিত করতে বেশ কয়েকটি টিম কাজ করছে। গোয়েন্দা সংস্থাও তথ্য-উপাত্ত খতিয়ে দেখছে।