আমার কাগজ ডেস্ক
সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের শাসনের অবসানকে ইরানের জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। ইরানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রদের মধ্যে অন্যতম সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। বিদ্রোহীদের ঝড়ো আক্রমণের মুখে আসাদ সিরিয়া থেকে পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনের পর সেখানে ইরানি দূতাবাসেও হামলা চালিয়েছে বিদ্রোহীরা। এর আগে লেবাননে ইরানের ছায়া সংগঠন হিজবুল্লাহকে দুর্বল করে দিয়েছে ইসরায়েল। আর হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে লেবাননে ইরানের উপস্থিতিও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েল হামাসের শীর্ষ নেতাকে হত্যা করে তাদের (হামাসের) ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আগামী মাসে দায়িত্ব নিচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি তার প্রথম মেয়াদে ইরানের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। এসব মিলিয়ে ইরানের পরিস্থিতি এখন বেশ উদ্বেগজনক।
এই সমস্ত কিছুর প্রভাব পশ্চিম এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্যের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সিরিয়ায় ইরানের দুর্বল হয়ে পড়াটা সে দেশের ভাবমূর্তি এবং আঞ্চলিক কৌশলের জন্য মারাত্মক আঘাত। এই অঞ্চলে তুরস্কের অগ্রসর হওয়ার বিষয়টা ইরানের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ।
বাশার আল-আসাদের পরিবার ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে ইরানের প্রধান আঞ্চলিক মিত্র। শুধু তাই নয় ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরান এবং ইরাকের মধ্যে যুদ্ধে সিরিয়াই একমাত্র আরব দেশ ছিল যারা ইরানকে সমর্থন করেছিল। বাকি আরব দেশগুলো কিন্তু ইরাকের সঙ্গে ছিল।
এরপর ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে বাশার আল-আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বাড়তে থাকে, কিন্তু ইরান তার সঙ্গ ছাড়েনি। এদিকে, ইরান কিন্তু সিরিয়া হয়ে লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং গাজায় হামাসকে সহায়তা পাঠাত।
আফতাব কমল পাশা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ওয়েস্ট এশিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক। অধ্যাপক পাশা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ইরানের সমস্যা হয়তো বেড়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক কিছুই সে দেশের অনুকূলে যাবে।
অধ্যাপক পাশা বলছেন, প্রথমত, ইরান দুর্বল হয়নি। ইরান হিজবুল্লাহকে ৩০০০ কোটি ডলার দিয়েছে। সিরিয়াকেও তারা ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। এখন এই সমস্ত অর্থ নিজেকে শক্তিশালী করার জন্য ব্যয় করবে ইরান। এতে তাদের পরমাণু কর্মসূচি ত্বরান্বিত হবে।
এর পাশাপাশি, অন্য একটা বিষয়ও উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক পাশা। তার কথায়, এরদোয়ান হয়তো এখনও মনে করতে পারেন যে তিনি জয়ী হয়েছেন, কিন্তু তার পুরো মনোযোগ ২০২৮ সালের নির্বাচনের দিকে। সিরিয়ায় কিন্তু এই অস্থির অবস্থা বজায় থাকবে। আমি মনে করি, সিরিয়াকে অনেক ভাগে ভাগ হতে পারে। কিছু এলাকা ইসরায়েলের দখলে চলে যাবে।
পাশা বলেছেন, ইসরায়েল ইতিমধ্যেই সেই কাজ শুরুও করে দিয়েছে। কিছু অংশ তুরস্কের দখলে চলে যাবে। সুন্নি ও আলবীয় একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে দেবে। কুর্দিরাও তাদের ভাগ দাবি করবে। এই অবস্থায় ইরানের পক্ষে সিরিয়ায় প্রবেশ করা কিন্তু কঠিন কাজ হবে না।
পশ্চিম এশিয়ায় ইরান দুর্বল হলে ভারতের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক পাশা। ইরান দুর্বল হওয়ার ফলে কী হতে পারে তা ব্যাখ্যা করেছেন অধ্যাপক পাশা।
তিনি বলছেন, ইরান দুর্বল হওয়ার অর্থ হলো তুরস্ক ও অন্যান্য সুন্নি দেশগুলোর শক্তিশালী হয়ে ওঠা। এই পরিস্থিতি পাকিস্তানের জন্য আরও অনুকূল হবে। ভারত ও ইরান থেকে সস্তায় গ্যাস পেতে পারে, কিন্তু আমেরিকার ভয়ে তারা (ভারত) সেই সাহস দেখাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ইরান বরাবরই অভিযোগ করে আসছে, তাদের বিষয়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সামনে মাথা নত করে। কিন্তু ভারত বুঝতে পেরেছে ইরান তার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ দেশ। মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী ইসরাইলের চাইতে শক্তিশালী ইরানকে বেশি প্রয়োজন ভারতের।
২০১৯ সালের নভেম্বরে ইরানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ মন্তব্য করেছিলেন, ভারতের উচিৎ তার মেরুদণ্ড শক্ত করা, যাতে তারা মার্কিন চাপের কাছে মাথা নত না করে।
জারিফ ভারত ও ইরানের সম্পর্কে সুফি ঐতিহ্যের কথাও উল্লেখ করেছিলেন।
তিনি জানিয়েছিলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আগে তাদের আশা ছিল যে ভারত ইরানের তেলের বৃহত্তম ক্রেতা হয়ে উঠবে। কিন্তু তা না হওয়ায়, তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ জানিয়েছিলেন, মার্কিন চাপের মুখে ভারতের আরও প্রতিরোধ দেখানো উচিৎ।
তিনি বলেছিলেন, ইরান বুঝতে পেরেছে যে, ভারত তার (ইরানের) উপর নিষেধাজ্ঞা চায় না, কিন্তু একইভাবে তারা (ভারত) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ক্ষুব্ধ করতে চায় না। আসলে অনেক সময় মানুষ কিছু একটা চায় অথচ তাকে অন্য কিছু করতে হয়।
এই বিষয়ে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ওয়েস্ট এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক অশ্বিনী মহাপাত্রকে জানান, বর্তমানে ইরানের অবস্থান দুর্বল হয়েছে বটে তবে চিরকালের জন্য তারা দুর্বল হয়ে যায়নি।
অধ্যাপক মহাপাত্র বলছেন, ইরানকে পশ্চিম এশিয়ায় একটা শক্তি হিসেবে ধরে রাখা ভারতের স্বার্থের জন্যই প্রয়োজন। ইরান দুর্বল হলে সুন্নি শাসকদের আধিপত্য বাড়বে এবং তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করবে।
তিনি বলেছেন, তুরস্কের প্রভাব বাড়বে এবং সেটা পাকিস্তানকেও সাহায্য করবে। এই পরিস্থিতিতে ইরানই পশ্চিম এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য আনে।
কীভাবে ভারতের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে তা ব্যাখ্যা করেছেন অধ্যাপক মহাপাত্র। তিনি বলেছেন, ইরানের মাধ্যমেই ভারত মধ্য এশিয়ার বাজারে পৌঁছায়। ইরানে চাবাহার বন্দর নির্মাণ করছে ভারত। এই পরিস্থিতিতে ইরান অস্থির হয়ে উঠলে নানান দিক থেকে ভারতের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তবে তিনি বলেছেন, আমি বিশ্বাস করি, দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে ইরান এই ক্ষমতা আবার ফিরে পাবে। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। ইরান প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। তারা নিজেদের পরমাণু কর্মসূচিও ত্বরান্বিত করবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ইরান জানে কীভাবে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। তথ্যসূত্র: বিবিসি