স্পোর্টস ডেস্ক
বলুন তো, ক্রিকেটের বিশ্বমঞ্চে লাল-সবুজের জার্সিতে প্রথম সেঞ্চুরি কার? এটা নিশ্চয় সবারই জানা, বাংলাদেশের কোনো ক্রীড়াপ্রেমীই বিষয়টি অজানা থাকার কথা নয়। কোনো ধরনের শঙ্কা ছাড়াই সবাই এই উত্তর দিতে পারবেন, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তবুও চলেন, গল্পটা একবার সবাই মিলেই স্মরণ করে নেই। ওহ হ্যাঁ, এখনও তো উত্তরটাই দেওয়া হয়নি। উত্তরটা ‘মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ’।
২০১৫ সালের ৯ মার্চ অ্যাডিলেড ওভালে অনুষ্ঠিত গ্রুপ পর্বের পঞ্চম খেলায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক সেঞ্চুরি করেন রিয়াদ। বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম সেঞ্চুরি করেন তিনি। দলীয় সংগ্রহ দুই অঙ্কের কোটা পার হওয়ার আগেই দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েস যখন প্যাভিলিয়নের পথ ধরলেন, তখনই একক নৈপুণ্যে বাংলাদেশকে ২৭৫ রানের সংগ্রহ এনেছিলেন। ১৩৮ বলে ইতিহাসের পাতায় লাল-সবুজের নাম লিপিবদ্ধ করে বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের বিশ্বমঞ্চে সেঞ্চুরির আক্ষেপ ঘুচিয়ে ছিলেন তিনি। সেদিন রিয়াদ দেখিয়েছিলেন, আমরাও পারি।
বিশ্বকাপে রিয়াদের আগে ওপেনার তামিম ইকবাল ও দেশের প্রথম ‘বৈশ্বিক সুপারস্টার’ মোহাম্মদ আশরাফুলও খুব কাছে গিয়ে সেঞ্চুরি বঞ্চিত হয়েছিলেন। তবে আজকের গল্পটা তাদের নিয়ে নয়। আজ বিশ্লেষণ হবে, ‘বিশ্বকাপে রিয়াদকে কেন ও কতটা প্রয়োজন’।
বলা হয়, ক্রিকেটে ভাগ্য-দেবতার আশীর্বাদ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, বিশ্বমঞ্চে লাল-সবুজের সেঞ্চুরি খরা লাঘবের পরপরই আরও অনন্য এক রেকর্ডে নাম লেখান রিয়াদ। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে ‘ব্যাক টু ব্যাক’ সেঞ্চুরির অনন্য নজির গড়েন মিডল-অর্ডার এই ব্যাটার। এতে করে রিয়াদ যেন বুঝিয়েই দিলেন, ক্রিকেট-বিধাতা যেন নিচে নেমে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন! তাই মাহমুদউল্লাহ রিয়াদই তো বিশ্বকাপ-সেঞ্চুরিয়ান, টানা দুই ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান, টাইগার ক্রিকেটে অনন্য এক রেকর্ডের নাম।
যদিও বাংলাদেশিদের হয়ে ২০০৬ সালে পরপর দুই ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন শাহরিয়ার নাফিস। কিন্তু পার্থক্যটা হলো দ্বিপাক্ষিক সিরিজ ও বিশ্বকাপ। তাই এই নিয়ে তুলনাও একপ্রকার সময় অপচয়।
৩৭ বছর বয়সী ময়মনসিংহের এই ক্রিকেটারকে বলা হয়, ‘সাইলেন্ট কিলার’। যেকোনো পরিস্থিতিতে দলের সংগ্রহে ছোটাতে পারেন রানের ‘রোশনাই’। অনেকটা নীরবেই ছড়ান আলোর জ্যোতি। আর নীরবতা বজায় রেখেই পাদপ্রদীপের আলোর বাইরে চলে গেছেন তিনি। কিন্তু তাকে ছাড়াই বিশ্বকাপ দল এটা কি ভাবা যায়? আপনি-আমি ভাবতেই পারি, বিশ্বকাপে তার থাকা-না থাকা; তবে এটা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) ওপর। রিয়াদকে বিশ্বকাপ দলে রাখবে কি, রাখবে না; তা নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। আমি দাবিও জানাচ্ছি না। কিন্তু কিন্তু কিন্তু…
ধুর ছাই, শুধু কি বিশ্বকাপের গল্পই শুনবেন! যেকোনো শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচেও যে তিনি (রিয়াদ) কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা-ও একটু বিশ্লেষণ করলে ক্ষতি কি!
দেশের ক্রিকেটে সিনিয়রদের ক্রিকেটারদের অবদান বর্ণনার করা যোগ্যতা আমার নেই। তাই বলে হামাগুড়ি দেওয়া দলটা যখন কিছুটা আলোর সন্ধান পেলো, তখনই বাদ রিয়াদ। আরে হ্যাঁ, বাদই বা কেন বলছি; না ভাই, আমি গুজব ছড়াতে চাই না। তাকে তো বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে। পঞ্চপাণ্ডবের এই পাণ্ডবকে বিশ্রাম দেওয়ার পর তিনটি সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে দুই সিরিজে জয়ের বিপরীতে হার একটিতে।
আরে ভাই, হারতেই পারে। খেলায় হার জিত আছেই, কেউ হারবে কেউই জিতবে; তাই বলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলের সঙ্গে! তবে দুটি সিরিজ জিতলেও আমরা যাকে নিয়ে আলোচনা করছি, তিনি যেই পজিশনে খেলেন, সেটার সফলতায় মার্কিং করলেই সিরিজ জয়ের পরও বাংলাদেশের শোচনীয় অবস্থার বিষয়ে খুব সহজে পূর্ণ ধারণা মিলবে। তবে হ্যাঁ, আলোচনা সংক্ষেপেই করা শ্রেয়।
রিয়াদের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররা দলের হাল না ধরলে এমনটাই হয়, পরাজয়ের ব্যবধান ও ব্যর্থতা নিয়ে শুধুমাত্র ‘লজ্জা’ শব্দই শোভা পায়। এই নিয়ে বিশ্লেষণে তো আর আতশি কাঁচের প্রয়োজন নেই। তিন ম্যাচ সিরিজের এক ম্যাচ বাকি থাকতেই ২-০ ব্যবধানে সিরিজ নিশ্চিত করে আফগানিস্তান চোখে আঙুল দিয়েই তা দেখিয়ে দিয়েছে।
তিন সিরিজে রিয়াদের বিকল্প হিসেবে তিনজনকে পরখ করা হয়েছে। ঘরের মাঠে আফগান সিরিজে রিয়াদের জায়গায় ব্যাট করেছেন আফিফ হোসেন ধ্রুব। প্রথম ম্যাচে ৮ বলে ৪ রান আর দ্বিতীয় ম্যাচে গোল্ডেন ‘ডাক’ উপহার দিয়েছেন আফিফ।
ইংল্যান্ডের চেমসফোর্ডে আয়ারল্যান্ড সিরিজে সাতে মেহেদী হাসান মিরাজকে দেখা গেছে। তবে এই সিরিজে মিরাজ খুব একটা খারাপ করেননি। প্রথম ওয়ানডেতে ২৭, দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ১৯ এবং সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে ৩৯ বলে ৩৭।
এ ছাড়া ঘরের মাঠে আইরিশদের বিপক্ষে ইয়াসির আলী চৌধুরীর ওপর আস্থা রাখা হয়েছিল। সেই যাত্রায় এই ক্রিকেটার প্রথম ওয়ানডেতে ১৭, দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৭ রান করেছিলেন। আর তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে ব্যাট হাতে নামার সুযোগ হয়নি তার। এরপরই বাদ পড়েন তিনি। গুঞ্জন রয়েছে, তার পারফরম্যান্সে টিম ম্যানেজমেন্ট সন্তুষ্ট না হওয়ায় বাদ পড়েন তিনি।
গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তার (রাব্বি) বাদপড়ার পর আফগানদের বিপক্ষে আফিফ যেভাবে খেলেছেন, তাতেও আপাতত সন্তুষ্টির কোনো কারণই নেই। বরং আফগানদের সঙ্গে হারের কারণ হিসেবে তাকেও (আফিফ) দোষারোপ করা হচ্ছে। স্পেশালিষ্ট ব্যাটার হিসেবে তাকে একাদশে টানা হয়েছিল।
এদিকে একাদশে যখন মিরাজসহ ৬ জন বোলার থাকেন, তখন তাকেও (মিরাজ) স্পেশালিষ্ট ব্যাটার হিসেবে গণ্য করে টিম ম্যানেজমেন্ট। তাই মিরাজকে ঘিরে বিশ্বকাপের মঞ্চে দুটি বিষয়ে বিবেচনায় নিতে পারে বাংলাদেশ। ছয় বোলারের একাদশে মিরাজ সপ্তম ব্যাটার। অন্যদিকে ৫ বোলারের একাদশে সপ্তম ব্যাটার হিসেবে থাকতে পারেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
এবার প্রশ্ন হতেই ইয়াসির ও আফিফদের মতো টগবগে তরুণ ক্রিকেটাররা থাকতে, বুড়ো রিয়াদই কেন বিশ্বকাপের সপ্তম ব্যাটার হতে যাবে। প্রশ্নটা আপনি করতেই পারেন। তাতে বাধা দিচ্ছে কে! তবে আমিও কি ছেড়ে দেওয়ার পাত্র? যুক্তি ছাড়া আমিও তাকে একাদশে রাখিনি। অভিজ্ঞ এই ব্যাটারের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সেই সেই ব্যাখ্যা মিলবে।
মনে আছে, দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের কথা? যাদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ঐতিহাসিক জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। ওই সিরিজের প্রথম ম্যাচে ১৭ বলে ২৫ রান করেছিলেন রিয়াদ। পরের ম্যাচে ৪৪ বলে ২৫ রান। সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে ব্যাট হাতে নামার সুযোগ মেলেনি রিয়াদের। কিন্তু এতো কম রান তা-ও রিয়াদের পক্ষ নিয়েই কথা বলছি। বলতেই পারেন, আপনার লজ্জা লাগে না। লজ্জা লাগবে কেন, বাকিরা কি প্রশংসা করার মতো নৈপুণ্য দেখিয়েছিল। না, পুরো দলের অবস্থাই বাজে ছিল। তা-ও দলের বিপদে কাণ্ডারি হয়েছিলেন রিয়াদ।
অ্যাওয়ে সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচই জিতেছিল লাল-সবুজেরা। প্রথম ওয়ানডেতে ৬৯ বলে অপরাজিত ৪১, তৃতীয় ওয়ানডেতে ৬১ বলে ২৬ রান করেছিলেন রিয়াদ। তবে দ্বিতীয় ম্যাচে ২২ গজে ব্যাট হাতে নামা হয়নি তার।
এবার প্রশ্ন করতেই পারেন, দুই সিরিজেই তো তার স্ট্রাইক রেট অনেক কম। কিন্তু ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে রিয়াদ যখন জয়ের উল্লাস নিয়ে মাঠ ছাড়লেন তখনও ৫৫ বল আর ৬ উইকেট হাতে আছে; এটাও কি দেখিয়ে দিয়ে বলতে হবে!
জিম্বাবুয়েতে অ্যাওয়ে সিরিজে টাইগাররা যখন নাকানিচুবানি খেয়েছিল, তখনও উজ্জ্বল ছিলেন রিয়াদ। প্রথম ওয়ানডেতে ১২ বলে ২০ রানের ক্যামিও, দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৮৪ বলে অপরাজিত ৮০ রান এবং তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে করেছিলেন ৬৯ বলে ৩৯ রান। রিয়াদের স্ট্রাইক রেট কম হলেও শেষ ম্যাচটিই জিতেছিল বাংলাদেশ।
এদিকে ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে প্রবল চাপের মুখে ৯৬ বলে ৭৭ রান করেন রিয়াদ। বাকি দুই ম্যাচেও কার্যকরী ভূমিকা ছিল তার।
সর্বশেষ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে খেলেছিলেন রিয়াদ। প্রথম ওয়ানডেতে ৪৮ বলে ৩১, দ্বিতীয়টিতে ৪৯ বলে ৩২ এবং তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে ৯ বলে ৮। মূলত এই সিরিজের পর পরই বিশ্রাম দেওয়া হয় ‘থ্যাংকসলেস জব’ দেওয়া এই ক্রিকেটারকে। আর তার বাদপড়ার যারাই দলে ঢুকেছেন, সবাই ৭ নম্বর স্লটেই ক্রিজে নেমেছেন। কিন্তু রিয়াদ প্রোটিয়াদের সঙ্গে ৬ নম্বরে, ক্যারিবিয়ানদের সঙ্গে ৪ নম্বরে, রোডেশিয়ানদের সঙ্গে ৫ নম্বরে এবং ভারতীয় ও ইংলিশদের সঙ্গে ৬ নম্বরে খেলেছেন।
এক কথায়, যেকোনো পজিশনেই এই ক্রিকেটারকে পরখ করে দেখা যায়। ব্যাটিং পজিশন নিয়েও তার কোনো দ্বিধা-মন্তব্য প্রকাশ্যে আসেনি। দলের কঠিন সময়েও সার্ভিস দিয়েছেন তিনি। তাই তার (রিয়াদ) অবদান হিসেবে করাও কতটা যৌক্তিক, তা আমার বোধগম্য না। এখন শেষ পর্যন্ত দেখার বিষয়, আবার কবে একাদশে ফেরেন লাল-সবুজের এই সাইলেন্ট কিলার।