
আমার কাগজ প্রতিবেদক
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়সীমা নিয়ে দেশে যে একটি অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তা অস্বীকার করা হবে রাজনৈতিক বাস্তবতা না বোঝার নামান্তর। এখানে ১৮ কোটি মানুষের দায় নেই, আছে তাদের সর্বনাশের শঙ্কা।
রক্তাক্ত সংগ্রামের চড়া মূল্য দিয়ে ঘটানো ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হওয়াটাই চরম হতাশার কিন্তু অভাবিত নয়।
বিপ্লবের অন্তর্নিহিত প্রত্যাশার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে না পারলে স্বাভাবিক কারণেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা।
জুলাই ২০২৪ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির যে আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিয়েছিল, মুক্ত বাংলাদেশে তার কোনো লিখিত রূপরেখা ছিল না, এখনো নেই। জুলাই ঘোষণাপত্রের আলোচনাও যেন আজ পুরোনো ‘ওয়াজ’।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ম্যান্ডেট নিয়ে পতিত আওয়ামী লীগ ছাড়া কারও অনাস্থা ছিল না; আবার এই সরকারের কাজের তালিকাও প্রস্তুত করেনি কোনো পক্ষ।
মোটাদাগে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, হত্যাকাণ্ড, দুর্নীতিসহ ফ্যাসিবাদী হাসিনা গংয়ের বড় অপরাধের বিচার, ভেঙে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ও পুনর্গঠন এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বোঝা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিমানটি উড়াল দিলেও আমাদের পরিষ্কার বোঝাপড়া থাকেনি এটি কোথায়, কীভাবে, কখন অবতরণ করবে।
জুলাই-আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ, গণমানুষের অংশগ্রহণ, প্রযুক্তির যুগে নতুন প্রজন্মের উত্থান, পুরোনো ব্যবস্থা উপড়ে ফেলা এবং পরিবর্তনের যাত্রা—বিপ্লবের এসব বৈশিষ্ট্য ২০২৪-এ উপস্থিত থাকলেও শুধু দলীয় নেতৃত্বে এটি সংঘটিত না হওয়ায় অনেকেরই একে বিপ্লব বলতে আপত্তি।
চলমান রাজনৈতিক বিতর্ক এবং পক্ষগুলোর মধ্যে সন্দেহ অবিশ্বাস নিশ্চিত করছে বেচারা বিপ্লবের ‘সৎভাই’; যার নাম নৈরাজ্য। বিপ্লবের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ (সম্ভাব্য) বর্গাচাষিদের সঙ্গে মাঠ বাস্তবতা ও আকাঙ্ক্ষার সংযোগ অনেকটাই যেন বিচ্ছিন্ন।
তবে আমাদের অংশীজনদের পরস্পরের মধ্যে দূরত্বের কারণ কেবল সংকীর্ণ ও অর্থহীন জেদাজেদিই নয়, বরং জাতীয় জীবনের মূল্যবান সময় ও শক্তি নষ্ট করা মাত্র।
২০০১ সালের নির্বাচনী ফলাফলের আলোকে ধরে নেওয়া বৃহত্তম দল বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করছে।
আর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিশ্রুত সময় ডিসেম্বর থেকে জুন ২০২৬-এর কোনো এক তারিখ। নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণের এই পার্থক্যটাই কি সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্বের প্রধান কারণ; নাকি সমস্যা আসলে অন্য কিছু?
সমস্যা যদি সত্যিই থেকে থাকে, তা হলো অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপি বা অন্য দু–একটি রাজনৈতিক জোটের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগের অভাব এবং ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট আস্থার সংকট।
তাদের এ দূরত্বে আরও কিছু ফ্যাক্টর ও গোষ্ঠী সক্রিয় আছে। তবে সব ইস্যু জনসমক্ষে প্রকাশের দরকারও পড়ে না যদি পরস্পরের মধ্যে আন্তরিক পরিবেশে আলোচনা হয়। সব পক্ষ চাইলে অবশ্য ঝেড়েও কাশতে পারে।
উভয় পক্ষই যদি অনড় অবস্থান নেয়, তবে দেশ যে আখেরে সংকটে পড়বে, তা বুঝতে চাণক্য কৌটিল্য হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
এখনকার সম্ভাব্য বাস্তবতা নিয়ে কেবল দুটি প্রশ্ন রাখা যায়: (১) ইউনূস সাহেব পদত্যাগ করলে পরবর্তী সরকার গঠন, সংস্কার এবং রাজনৈতিক গতিধারা নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা কি আদৌ সম্ভব হবে? এবং (২) যদি জাতীয় এজেন্ডা বাদ দিয়ে দ্রুতই যেনতেনপ্রকারেণ নির্বাচন করে একটি সরকার গঠিত হয়, তাহলে বিপ্লবের কোনো অঙ্গীকার, বিশেষ করে জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণের বাধ্যবাধকতা কি থাকবে?
এখন যদি ইউনূস সরকারের থাকা না–থাকার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তবে বর্তমান নেতৃত্বকে যেমন অপমান করা হবে, তেমনি ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হবে দায়িত্বপ্রাপ্তির আগেই।
সে পরিস্থিতিতে পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি দেশের বিভিন্ন স্থানে শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করতে পারে।
তাতে ৫ আগস্ট যে সহিংসতা ঠেকানো সম্ভব হয়েছে, তা কঠিন হয়ে পড়বে। যে জনতা সেদিন রাস্তায় নেমে এসেছিল, তারা চরম প্রতিক্রিয়াও দেখাতে পারে।
ক্ষমতা ও রাজনীতিতে চরম পন্থা বেছে নিলে জাতির কী পরিণতি হয়, সে নজির পৃথিবীতে ভূরি ভূরি আছে।
রাষ্ট্রের সব বিষয়ে ব্যক্তিগত জেদাজেদির আশ্রয় নিলে নেতৃত্বেরও শেষ পর্যন্ত কী দশা হয়, তার টেক্সটবুক দৃষ্টান্ত কি ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত শেখ হাসিনা নন?
জুলাই-আগস্ট ২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশে যে নতুন আশার সৃষ্টি হয়েছিল, তা মুহূর্তেই উবে যেতে পারে যদি চলমান প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। তাতে সবচেয়ে লাভবান হবে কারা তা আক্কেল-জ্ঞান আছে, এমন সবাই বোঝে।
এমতাবস্থায় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের আবেগপ্রবণ হওয়ার সুযোগ নেই; কারণ, ‘অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী’ না হয়ে জাতীয় উত্তরণের এক মহান দায়িত্ব তিনি কাঁধে নিয়েছেন।
বিগত সময়ের ঘৃণার রাজনীতির বিপরীতে এ দেশের মানুষ তাঁকে ভালোবেসে নেতা বানিয়েছে ও মেনেছে ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের পথ প্রশস্ত করতে।
দেখা যাচ্ছে, সেই আশাজাগানিয়া পরিবেশকে আস্থার সংকটে ফেলছে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের ঘাটতি।
অধ্যাপক ইউনূস যখনই নিজে কথা বলেছেন, তখন ভুল–বোঝাবুঝি খুব একটা থাকেনি। কিন্তু নিয়মিত এ কাজটি তাঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়, কখনো কখনো সমীচীনও নয়।
লক্ষ করা গেছে, কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতা ইউনূস সাহেবের সামনে ‘মনের কথাটা’ খুলে বলতে পারেন না।
তাই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সার্বক্ষণিক আলাপ ও পরামর্শ করার জন্য উপদেষ্টা পরিষদের মধ্য থেকে বা নতুন দায়িত্ব দিয়ে উচ্চপর্যায়ের ‘ট্রানজিশন টিম’ গঠন করলে কাজ হতে পারে।
ইতিমধ্যেই পরস্পরকে আক্রমণ করে আনুষ্ঠানিক পরিসরে কথা বলে আমরা প্রমাণ করেছি এবং করছি রাজনৈতিক বা ক্ষমতার প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার ‘হাসিনা-সংস্কৃতি’ আমাদের কতটা গ্রাস করেছে। সরকারের বেতনভুক্ত তালিকায় থাকা দু–চারজনের লাগামহীন বক্তব্যও উদ্বেগের বিষয়। নতুন বাস্তবতা কিছুটা বুঝলেও অতীত সংস্কৃতির ভারে আমাদের কেউ কেউ গ্রহণ করতে পারছেন না যে সময়টা আগের ধারার ছেদ টেনে এগিয়ে যাওয়ার।
বিএনপি বা অপরাপর রাজনৈতিক দল এমন ‘লোকেদের’ সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী বা বলে সন্তুষ্ট হবে না, যাঁরা ক্যাবিনেট সভায় যোগদান করতে পারেন না।
এ ধরনের আলোচনা শুধু দুপক্ষের দূরত্ব কমানো নয়, গণ-আস্থা তৈরিতে ভূমিকা রাখবে।
সংস্কারের রাজনৈতিক সমর্থন ও মালিকানা এবং দলীয় এজেন্ডার (ইশতেহার) প্রতি জনগণের বিশ্বাস নিশ্চিত করতে না পারলে আমরা অতীতের শাসনব্যবস্থাতেই ফিরে যাব, তার নাম যা-ই হোক।
ইউনূস সরকারের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে ও নতুন গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা এবং জাতীয় স্বার্থের ধারণা থেকে বিএনপিকে যদি বিচ্যুত ও গণবিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়, ফ্যাসিবাদী শক্তি এবং এ দেশের গণতন্ত্রের শত্রুদের চেয়ে আর কে বেশি খুশি হবে?
একই সঙ্গে হাসিনা আমলের ভোটারবিহীন নির্বাচনকে কাজে লাগিয়ে কাগজে–কলমে জনপ্রতিনিধি হওয়ার চেষ্টার মতো দাবা খেলার চাল ওই নেতৃত্বের প্রতি সজ্জন মানুষকে আকৃষ্ট করবে না।
গণতন্ত্র মানলে ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার নৈতিক ভিত্তি জোরদার থাকতে হয়, অংশীজনের মাধ্যমে সামাজিক সংলাপের জানালাও খোলা রাখতে হয়।
গত দেড় দশকের শাসন বাদ দিলে নির্বাচিত সরকার তো বটেই, এমনকি স্বৈরাচারী এরশাদ শাসনামলেও সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে গণতন্ত্রকামী দলগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করতেন কিছু গণ্যমান্য নাগরিক বা সিভিল সোসাইটি।
এখন নতুন করে তাঁরা ভূমিকা রাখতে পারেন, যদি তাঁরা মনে করেন দেশের ও মানুষের জন্য তাঁদের কিছু করার আছে।
ইতিমধ্যেই পরস্পরকে আক্রমণ করে আনুষ্ঠানিক পরিসরে কথা বলে আমরা প্রমাণ করেছি এবং করছি রাজনৈতিক বা ক্ষমতার প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার ‘হাসিনা-সংস্কৃতি’ আমাদের কতটা গ্রাস করেছে।
সরকারের বেতনভুক্ত তালিকায় থাকা দু–চারজনের লাগামহীন বক্তব্যও উদ্বেগের বিষয়।
নতুন বাস্তবতা কিছুটা বুঝলেও অতীত সংস্কৃতির ভারে আমাদের কেউ কেউ গ্রহণ করতে পারছেন না যে সময়টা আগের ধারার ছেদ টেনে এগিয়ে যাওয়ার।
দুঃখজনকভাবে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেরও কারও কারও বোধগম্য হচ্ছে না যে জুলাই আন্দোলনে জীবন বাজি রাখা একটি বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে অন্যের ছিদ্রান্বেষী বক্তৃতাবাজি ও ক্ষমতার ঔদ্ধত্যের রাজনীতি রীতিমতো অপ্রাসঙ্গিক।
প্রাসঙ্গিক হচ্ছে নতুন ভোটারদের ভবিষ্যৎ গড়তে কোন দলের পরিকল্পনা কী, তা জানা।
বিপ্লব-পরবর্তীকালে, যতটুকু বুঝি, এ ভূখণ্ডের শান্তিপ্রিয় মানুষের সাধারণ চাওয়া এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, যেখানে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে ও প্রাণ খুলে কথা বলতে পারবে এবং ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি ও সন্ত্রাস তাদের হাত-পা বেঁধে ফেলবে না।
মনে রাখা দরকার, চরমপন্থী রাজনীতি এ দেশে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে।
সুতরাং বৃহত্তর জাতীয় মিটমাটের খাতিরে অধ্যাপক ইউনূস তাঁর রাজনৈতিক হাত দলগুলোর দিকে আরেকটু বাড়িয়ে দিলে তিনি ছোট হবেন না, তাতে তাঁর মহানুভবতাই প্রকাশ পাবে।
অন্যদিকে বিএনপিসহ গণতান্ত্রিক দলগুলো মতপার্থক্য দূরীকরণ এবং ঐকমত্য নির্মাণে একটি জাতীয় সংলাপে সক্রিয়ভাবে শরিক হলে আগামীর যাত্রায় সম্মানজনক নেতৃত্ব প্রাপ্য হবে তাদেরই।