
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রিন্স
সরকারিভাবে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন করা হলো এ বছরও। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ছিলো ‘The teachers we need for the education we want: The global imperative to reverse the teacher shortage’. অর্থাৎ ‘আমরা যে শিক্ষা গ্রহণ করতে চাই তার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষক: শিক্ষকের স্বল্পতা কাটানো বৈশ্বিক দাবি’। প্রতিপাদ্য বিষয়ের ১ম অংশের আলোকে বলা যায় মানসম্মত শিক্ষা ও টেকসই শিখন শেখনে উপযুক্ত শিক্ষকের বিকল্প নাই এবং এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা। প্রশ্ন হলো এ উপযুক্ত শিক্ষক কারা? শ্রেণি কক্ষে অনেক বেশি নৈপুণ্য প্রদর্শনকারী শিক্ষক-ই কী উপযুক্ত শিক্ষক? কিংবা পাঠদানে অপার পারদর্শী শিক্ষক-ই কী উপযুক্ত শিক্ষক? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজত গিয়ে প্রতিপাদ্যের গভীর মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারায় আমার মনে হলো উপযুক্ত শিক্ষক বলতে পঠন-পাঠনে কিংবা শিখন-শেখনে উচ্চতর দক্ষতা সম্পন্ন এমন শিক্ষকের কথা বলা হয়েছে, যে শিক্ষক হবে একজন শিক্ষা গবেষক, সমাজ সংস্কারক, মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ নীতি-নৈতিকতায় উত্তম চারিত্রিক গুণাবলীর একজন অনুকরণীয় ও অনুস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।এমন শিক্ষকই হবেন একজন উপযুক্ত শিক্ষক। কালের বিবর্তনে উপযুক্ত শিক্ষক খুঁজে বের করা দুরূহ হলেও কালেভদ্রে এমন শিক্ষক যে পাওয়া যায় না, তা আমি বলবোনা। এটাও সত্য উপযুক্ত শিক্ষক বিনির্মানে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিরা দায় এড়াতে পারেনা। সমাজ সংস্কার ও উন্নত জাতি গঠনে শিক্ষকদের অসামান্য অবদান স্মরণ করার নিমিত্তে জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কোর সদস্যভুক্ত প্রতিটি দেশে ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর ” বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে ” দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে এ দিবসটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে না হলেও বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন ও কিছু প্রতিষ্ঠান এ দিনে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় এ বছর দিবসটি প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের ঘোষণা দিলে এ দেশের অগণিত শিক্ষক তাদের অধিকার ও মর্যাদা আদায়ে বিপুল আশায় বুক বাঁধে। এ কথা প্রায় সবারই জানা,বাংলাদেশের মোট শিক্ষার ৯৭ ভাগ বেসরকারি খাতে পরিচালিত এবং শিক্ষার সিংহভাগ সফলতার দাবিদার বেসরকারি খাতই। কালের কপোলতলে সময়ের দাবিতে বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে মাস ব্যাপী আন্দোলন করেন। স্মরণকালের এ শিক্ষক আন্দোলনে সরকারের লেজুড় ভিত্তিক একটি শিক্ষক সংগঠন ছাড়া যুগ যুগ ধরে শিক্ষক আন্দোলনের পুরোধা সংগঠনগুলো জাতীয়করণের এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করলে একপর্যায়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও শিক্ষা বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতির মধ্যস্থতায় আন্দোলন স্থগিত করা হয়। সরকারি জনদের প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস থেকে এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সরকারের তরফ থেকে শিক্ষক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটা আশাব্যঞ্জক ঘোষণা আসবে এমনটাই প্রত্যাশা ছিল দেশব্যাপী শিক্ষকদের। শিক্ষা মন্ত্রীর সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয়ভাবে উদযাপিত বিশ্ব শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির ভাষণে, উপযুক্ত শিক্ষক গঠনের কোন দিক নির্দেশনা বা শিক্ষা ও শিক্ষকের জীবন মান উন্নয়নে কিংবা শিক্ষা জাতীয়করণ বিষয়ে কোন বক্তব্য না আসলেও গতানুগতিক বক্তব্যে কতিপয় শিক্ষকের কোচিং বাণিজ্য বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হোক এটা সচেতন প্রতিটি শিক্ষকই চায়।কিন্তু কোচিং কেন করে এহেন বক্তব্য প্রদানকারীরা কি আদৌ জানে? তাঁরা কি জানে বর্তমান দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্ব গতির বাজারে শিক্ষকরা কত বেতন পায়? রঙচটা এ শহরে শিক্ষকদের বাড়িভাড়া ১০০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা? উৎসব ভাতা ২০ বছর আগে নির্ধারিত ২৫%? সরকারি-বেসরকারি বেতন বৈষম্য কমাতে, শিক্ষকের মর্যাদা নিশ্চিত করতেই হয়েছে শিক্ষক আন্দোলন।শিক্ষকের কাজ শ্রেণি কক্ষে থাকা রাজপথে থাকা নয়। শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবির প্রতি বিশ্ব শিক্ষক দিবসের কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানে নূন্যতম সম্মান না দেখিয়ে উল্টো কোচিং বাণিজ্যের কালিমা দেয়া হলো শিক্ষকদের। শিক্ষা সংশ্লিষ্টজন, শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করুন, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর আলোকে পৃথক শিক্ষক বেতন কমিশন গঠন পূর্বক শিক্ষকদের জন্য এমন একটা বেতন কাঠামো গঠন করুন, যাতে কোন শিক্ষকের আর লজ্জার কোচিং না করতে হয়। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষকের মর্যাদা নিশ্চিত করুন, তবেই পাবেন উপযুক্ত শিক্ষক। অবিলম্বে শিক্ষা জাতীয়করণ ঘোষণা দিন, শিক্ষায় আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
এবারের প্রতিপাদ্যের ২য় অংশে শিক্ষক স্বল্পতা কাটিয়ে ওঠার দাবি জানানো হয়েছে, এ বিষয়ে আমার বক্তব্য হচ্ছে, শিক্ষকের অধিকার ও মর্যাদা সুনিশ্চিত করা হলে মেধাবীরা এ পেশায় আকৃষ্ট হবে। যতবেশি মেধাবী ও গুণীরা শিক্ষকতা পেশায় আসবেন, শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে তাতো বেশী ভূমিকা রাখবে এবং শিক্ষক স্বল্পতা দূর হবে।
লেখক : শিক্ষক, গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং অতিরিক্ত মহাসচিব, বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়ন-বাশিইউ।