আমার কাগজ প্রতিবেদক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা হওয়া জোড়া শিশু নুহা-নাবা এখন হাসপাতালের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলাদা হওয়ার পর গত আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে শিশু দুটি বাবা-মাসহ হাসপাতালেই রয়েছে। কথা ছিল সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালেই থাকবে তারা। চিকিৎসাসহ সবকিছুই চলবে বিনামূল্যে। এতদিন সেভাবেই চলছিল সব।
তবে নুহা-নাবার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন। এত দীর্ঘ সময় কোনো রোগীর হাসপাতালে থাকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বিতর্ক এড়াতে বেঁকে বসেছে বর্তমান প্রশাসনও। তারা আর শিশু দুটিকে হাসপাতালে রাখতে চাইছে না। উপাচার্য প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে শিশু দুটিকে নিয়ে হাসপাতাল ছাড়তে বলেছে বাবা-মাকে। কর্মকর্তারা এমনও বলেছেন, শিশু দুটি এখন সবার গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা গেলে সবাই বাঁচে।
এ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন নুহা-নাবার বাবা-মা। বাবা আলমগীর হোসেন তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই বাচ্চা দুটির চিকিৎসা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। এখন হাসপাতাল থেকে চলে যেতে বলেছে। অথচ বাচ্চা দুটি এখনো সুস্থ হয়নি। কুড়িগ্রামের বাড়িতে থাকি না আড়াই বছর ধরে। সেখানকার পরিবেশে বাচ্চাগুলোর কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছি না। পরে কোনো সমস্যা হয় কি না, সেই ভয় পাচ্ছি। প্রস্রাব ও পায়খানার রাস্তায় যে অপারেশন হয়েছে, সেখানে এখনো শুকায়নি, ঘা আছে। তারা এক সপ্তাহ পর্যন্ত দেখবে। কী করব বুঝতে পারছি না। সবাই এত কষ্ট করে এতদিন ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করলেন, রাখলেন, আর মাত্র দুই-তিন মাস যদি রাখতেন। এরপর শেষ আরেকটা করে অপারেশন হলেই চিকিৎসা শেষ।’
আলমগীর হোসেন জানান, নুহা-নাবা দুজনের একটা করে অপারেশন বাকি আছে, যা শিশু সার্জারি বিভাগ করবে। এ অবস্থায় আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ কে এম জাহিদ হোসেন নিউরোসার্জারি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসককে ডেকে বলেছেন আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ছুটি দিতে। বাকি অপারেশন পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ করে পরে করাতে হবে। তবে পরে অপারেশন কোন প্রক্রিয়ায় হবে, এ বিষয়ে কেউ কোনো ধারণা দেননি।
নুহা-নাবার বাবা আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমাদের ছুটি দিক, অসুবিধা নেই। কিন্তু পরে যেন ভর্তি হতে পারি ও অপারেশনটা বিনামূল্যে হয় হাসপাতাল থেকে যেন এ উপকারটা করে। কিন্তু সেটা তো কেউ কিছু বলছে না।’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পৃথিবীতে ৩৩ মাস হাসপাতালে রেখে রোগীর চিকিৎসার রেকর্ড আছে কি না, আমাদের জানা নেই। তৎকালীন সরকার কমিটমেন্ট করেছিল, ঠিক আছে। কিন্তু এত দীর্ঘ সময় হাসপাতালে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তারা করেছিল জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য। পৃথিবীতে কি সর্বোচ্চ জটিল রোগী এটাই? বুঝলাম কুড়িগ্রাম। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সে করে তো আসা-যাওয়া যায়। এগুলো কোনো বিবেচনাপ্রসূত কাজ ছিল না। এখানে প্রতিদিন কত মূমুর্ষু রোগীর চাপ।
শিশু দুটি এখন চলে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক ডা. একেএম জাহিদ হোসেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ওনাদের চিকিৎসা তো মোটামুটি শেষ। এখন একটা অপারেশন আছে। সেটা পরে করতে হবে। এখন দরকার নেই আপাতত। ওই অপারেশন করতে সময় লাগবে। অনেক দিন ধরে হাসপাতালে আছে। চলে গেলে অসুবিধা হবে না। আড়াই বছর ধরে একটা হাসপাতালে রোগী থাকে?’
তবে শিশু দুটির সম্পূর্ণ চিকিৎসার নিশ্চয়তা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিশু দুটির প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। কোনোভাবেই তাদের চিকিৎসাবঞ্চিত করা হবে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সীমিত সম্পদ ও সামর্থ্য সেটার সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যবস্থা করা হবে।’
ভুয়া সনদে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নেওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকা হচ্ছেভুয়া সনদে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নেওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকা হচ্ছে
৩১ মাস ধরে হাসপাতালে : গত বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি বিএসএমএমইউর চিকিৎসকরা জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা করেন জোড়া লাগানো শিশু নুহা ও নাবাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি অনুষদের ডিন ও নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেনের নেতৃত্বে সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ১৫ ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে অংশ নেন ৩৯ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ মেডিকেল টিমের শতাধিক সদস্য। সেই থেকে বাবা-মার সঙ্গে হাসপাতালের কেবিন ব্লকে ৬১৮ নম্বর কক্ষে রয়েছে শিশু দুটি। গত ২১ মার্চ এখানেই কেটেছে নুহা-নাবার দ্বিতীয় জন্মদিন।
জন্মের ১৪ দিনের মাথায় ২০২২ সালের ৪ এপ্রিল নুহা ও নাবাকে এই হাসপাতালে নিয়ে আসেন তার বাবা-মা। বাবা আলমগীর হোসেন রানা একজন পরিবহন শ্রমিক। মা নাসরিন আক্তার গৃহবধূ। বাড়ি কুড়িগ্রাম সদরে। এটা তাদের দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম সন্তান একটা ছেলে। বয়স ১০ বছর। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ওর আট বছর বয়সে নুহা-নাবার জন্ম হয়। দুই বছর ধরে সেই ছেলেও সবার সঙ্গে হাসপাতালেই আছে।
জানা গেছে, প্রথম আট মাস হাসপাতালের ওয়ার্ডে ছিল শিশু দুটি। সেখানে খরচ হয় ৫ লাখ টাকার মতো। পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসার দায়িত্ব নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেই থেকে গত ৩১ মাস ধরে হাসপাতালেই আছে শিশু নুহা-নাবা।
এখন গলার কাঁটা : এখন আর শিশু দুটিকে হাসপাতালে রাখতে চাইছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, ভর্তির সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলেছিল, শিশু দুটির চিকিৎসা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রেখে বিনামূল্যে চিকিৎসা সম্পূর্ণ করবে। কিন্তু এখন চিকিৎসা নিয়ে নানা জটিলতা হচ্ছে। মূল চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন হাসপাতালে আসেন না। তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন শিশুর বাবা-মা। গত ১০ আগস্ট হাসপাতালের রেন্ট কালেক্টর কেবিনে ভাড়া চেয়েছে। আবার ২৩ অক্টোবর বর্তমান উপাচার্যের পিএস-১ ইয়াহিয়া খান নুহা-নাবার বাবাকে ডেকে বলেছেন তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শেষ করে ছুটি নিতে, তা না হলে চিকিৎসার খরচ নিজেকে বহন করতে হবে এবং সম্পূর্ণ কেবিন ভাড়া দিতে হবে। সর্বশেষ গত রবিবারও উপাচার্যের পিএস-২ সাইফুল ইসলাম নুহা-নাবার বাবাকে ডেকে বলেছেন, ‘আপনারা বর্তমানে হাসপাতালের গলার কাঁটা হয়ে আছেন। ছুটি নিয়ে চলে গেলে সবাই বাঁচে।