
আমার কাগজ প্রতিবেদক
সন্ত্রাসী হামলার বিচারের দাবি, ওয়াজ মাহফিলের প্রচার, শ্রদ্ধাঞ্জলী, রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মসূচি থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন; কী নেই ঢাকার মেট্রোরেলের পিয়ারে।
কিছু জায়গায় এমনভাবে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে যে, মেট্রোরেলের পিয়ার বলে ঠাওরই করার উপায় নেই। একটি দলের পোস্টার পাওয়া গেছে পুরো মেট্রোরেল এলাকা জুড়ে!
গুরুত্ব অনুযায়ী ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল এলাকা কেপিআইভুক্ত (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা)। সে হিসেবে মেট্রোরেলের স্থাপনায় কোনো পোস্টার লাগানো, দেয়াল লিখন, ছবি আঁকা যাওয়ার কথা না। তবে সেটা মানছে না কেউ।
২০২২ সালে দেশের প্রথম মেট্রোরেলের যাত্রা শুরুর আগেই এর অবকাঠামোতে পোস্টার পড়তে শুরু করেছিল। তবে মেট্রো চালুর পর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং ডিএমটিসিএলের কড়াকড়িতে তাতে ভাটা পড়ে কিছুটা।
গত বছরের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে ঢাকার বিভিন্ন স্থাপনার পাশাপাশি গণ অভ্যুত্থানের পক্ষে নানা দেয়াল লিখন, গ্রাফিতি আঁকা হয়। ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতার আসার পর নতুন আরও গ্রাফিতি, দেয়াল লিখন হয় মেট্রোরেলের পিয়ারগুলোতে।
তবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার পক্ষের গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখনের ফাঁকে এখন দেদারছে পোস্টার লাগানো হচ্ছে, যা ‘দৃষ্টিদূষণের’ কারণে হয়ে উঠেছে।
মতিঝিল থেকে মিরপুর-১২ নম্বর পর্যন্ত মেট্রোরেলের লাইন ধরে ঘুরে দেখা গেছে মোটামুটি সব এলাকায় রয়েছে পোস্টার।
সবচেয়ে বেশি পোস্টার পড়েছে প্রেস ক্লাব, পল্টন এলাকায় মেট্রোরেলের পিয়ারগুলোতে। শুধু পিয়ারই নয়, মেট্রো স্টেশনে ওঠার সিঁড়ি, বিদ্যুতের বোর্ডসহ সবকিছুইতে পোস্টার লাগানো হয়েছে।
মতিঝিল থেকে মিরপুর ১২ নম্বর পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি পিয়ারেই ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’র (এবি পার্টির) পোস্টার। দলটি তাদের প্রথম জাতীয় কনভেনশনের পোস্টার লাগিয়েছে বিভিন্ন পিয়ারে।
জানতে চাইলে এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, “পোস্টারগুলো বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে লাগানো হয়েছে। তারা হয়তো আমাদের ইনস্ট্রাকশন ফলো করেনি। এ কারণে মেট্রোরেলের পিয়ারে পোস্টার লাগিয়ে দিয়েছে। আমি যেহেতু বিষয়টি পুরোপুরি জানি না, খোঁজ নিয়ে বলতে হবে।”
পল্টন থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাব হয়ে কদম ফোয়ারা পর্যন্ত গণঅধিকার পরিষদের রেজওয়ানুল হক শাওন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় সমন্বয় কমিটি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ আন্দোলন, মহিউদ্দিন আহমেদের শ্রদ্ধাঞ্জলি, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, বাংলাদেশ ইসলামী সমন্বয় পরিষদ, বিএনপি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জাতীয় কারিগর ও শিল্প শ্রমিক ফেডারেশন, ইসলামী যুব আন্দোলন, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, দৈনিক আমাদের দিনের প্রতিষ্ঠার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে।
পোস্টারের মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠানও বিজ্ঞাপন দিয়েছে মেট্রোরেলের পিয়ারে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রযোজনাভিত্তিক চলচ্চিত্র কর্মশালায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে প্রেস ক্লাব এলাকায় পোস্টার লাগিয়েছে শিল্পকলা একাডেমি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাংলাদেশী আন্দোলনের ‘মুভ বাংলাদেশ মুভ’, এক্ষুনি সিন্ডিকেট ‘ভেঙে দাও, সকল পণ্যের দাম কমাও’ লেখা পোস্টার, এবি পার্টির পোস্টার দেখা গেছে।
শাহবাগ থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত মেট্রোরেলের পিয়ারে খুব বেশি পোস্টার দেখা যায়নি। তবে ফার্মগেট এলাকায় রেটিনা কোচিং সেন্টার, জাতীয় পার্টি, জিয়াউর রহমান পরিষদ, উন্মেষ কোচিং, কর্নিয়া কোচিং, ফার্মগেট কাজী অফিস, ফোকাস কোচিং, কুতুববাগ দরবার শরীফের পোস্টার লাগানো হয়েছে মেট্রো রেলের পিয়ারে।
ফার্মগেট থেকে বিজয় সরণি হয়ে আগারগাঁও পর্যন্ত খুব বেশি পোস্টার দেখা যায়নি। তবে এই অংশে এবি পার্টির পোস্টার আছে।
আগারগাঁও থেকে মিরপুর ১০ নম্বর হয়ে ১২ নম্বর পর্যন্ত ঘুরে হিযবুত তাহরীর, উলাই’য়াহ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিস, কয়েকটি ওয়াজ মাহফিলের দাওয়াত এবং কোচিং সেন্টারের পোস্টার দেখা গেছে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফ গণমাধ্যমকে বলেন, বিভিন্ন পিলারে পোস্টার লাগানো হয়েছে। এছাড়া ভবঘুরে লোকজন কিছু এলাকায় পিলারের নিচে বসবাস শুরু করেছে। এসবের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে, তবে এখন তারা জনগণকে সচেতন করছেন।
“আমরা লোকজনকে বোঝানোর চেষ্টা করছি যে এসব জায়গায় যেন পোস্টার না লাগায়।”
আবদুর রউফ বলেন, যারা পোস্টার লাগাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া যায়। কিন্তু ডিএমটিসিএলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নেই।
তিনি বলেন, “আইন প্রয়োগের এখতিয়ার সিটি করপোরেশনের। সিটি করপোরেশনের ম্যাজিস্ট্রেট আছে, তারা ব্যবস্থা নিতে পারে। উনাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আমরা যোগাযোগ করেছি। আইনি ব্যবস্থা নিতে হলে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করতে হয় যা আমাদের নেই। সেটা তো সরকারের হাতে, এটা নিয়ে আমরা লিখছি।”
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো. মাহবুবুর রহমান তালুকদার বুধবার বলেন, “জুলাই গণ অভ্যুত্থানের সময় মেট্রোরেলের পিয়াারে আন্দোলনসংশ্লিষ্ট অনেক দেয়াল লিখন, গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পোস্টার লাগিয়েছে অনেক ব্যক্তি, সংস্থা। এসব পোস্টার সরিয়ে ফেলা হবে।
“অভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ব্যানার, গ্রাফিতি পোস্টারে আমরা এখন হাত দিচ্ছি না। কিন্তু এছাড়া অন্য যেসব পোস্টার আছে আমরা সেগুলো তুলে দেব। ঢাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডেও নানা পোস্টার, ব্যানারে ছেয়ে গেছে। আমরা এরইমধ্যে সেগুলো অপসারণের কাজ শুরু করেছি।”
উত্তর সিটি করপোরেশনও বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন।
“বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। হাতেনাতে ধরতে না পারলে তো মামলা করা যায় না। কিন্তু পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আমাদের কর্মীরা প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকার পোস্টার অপসারণ করছে। মেট্রোরেলের পিয়ার থেকেও পোস্টার সরানো হচ্ছে।”
উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার। ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ যাত্রী পরিবহনের জন্য চালু হয়। উত্তরা থেকে মতিঝিল অংশে মেট্রো চলাচল শুরু করে ২০২৩ সালের ২৫ নভেম্বর। আর এ বছরের জুন মাসে মেট্রোরেল কমলাপুর পর্যন্ত যাওয়ার কথা রয়েছে।
উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার অংশে মোট পিয়ারের সংখ্যা ৭৩১টি। এই অংশে মোট ১৬টি স্টেশন, মোট স্টেশন ১৭টি।