মুশফিকুর রহমান
বিশ্বের বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে এবার ১৮তম লোকসভা নির্বাচন প্রায় শেষের পথে। ষষ্ঠ ধাপের ভোটগ্রহণও শেষ হয়েছে। এবারের লোকসভা নির্বাচন হচ্ছে ৪৪ দিন সময় নিয়ে। সাত ধাপের এ নির্বাচন শেষ হবে আগামী ১ জুন। ফলাফল জানা যাবে ৪ জুন। ভারতে মোট ভোটার প্রায় ৯৭ কোটি। নির্বাচন হচ্ছে ৫৪৫টি আসনের ৫৪৩টিতে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে একটি দলকে অথবা জোটকে ন্যূনতম ২৭২টি আসন পেতে হবে। নির্বাচনের বাজেট ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪৪০ কোটি রুপি। ভোট গ্রহণ হচ্ছে প্রায় ১০ লাখ ৫০ হাজার কেন্দ্রে। বিশ্বের বৃহত্তম এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভোটের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে আছে পুরো বিশ্বেও মানুষ।
নির্বাচনের আগে যে সমস্ত জরিপ হয়েছে তার সবগুলোতেই নরেন্দ্র মোদির বিপুল বিজয়ের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য জরিপগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে এনডিএ জোটের ভোটপ্রাপ্তি সর্বোচ্চ ৫২ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ। সেখানে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোটের ভোট প্রাপ্তির হার সবচেয়ে বেশি হলে ৪২ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন হলে ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু ৪র্থ দফা ভোটগ্রহণের পর বিশ্লেষকদের অনেকেই ভোটের এই জরিপ শেষ পর্যন্ত টিকবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন।
গত নির্বাচনের মতো বিজেপির হাতে এবার রামমন্দির ও কাশ্মিরের পুলওয়ামার ঘটনার মতো পাকিস্তানবিরোধী কোনো অ্যাজেন্ডা নেই। তাই, বিজেপিকে অন্যান্য ব্যর্থতা ঢাকতে ধর্মীয় কার্ডকে বেশি বেশি ব্যবহার করতে হচ্ছে। নির্বাচনে জিততে মোদীকেসরাসরি সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে দেখা যাচ্ছে। যা এর আগে ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে এমনটি দেখা যায়নি।
বিজেপি এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় কৌশল হিসেবে প্রথমে বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মীয় অনুভ‚তি কাজে লাগাতে চেয়েছিল। তবে রামমন্দির নির্মাণের আগে যে উন্মাদনার কথা শোনা গিয়েছিল, মন্দির উদ্বোধনের পর সেটা দেখা যায়নি।
এ কারণেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজস্থানে এক সমাবেশে সরাসরি সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন। এর আগে ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে এমনটি দেখা যায়নি।
নরেন্দ্র মোদির এসব বক্তব্য নিয়ে ভারতে এখন তোলপাড়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ৪র্থ দফা নির্বাচনের পর বিজেপি ও জোটের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা লক্ষণীয়। যেহেতু এবার গত নির্বাচনের মতো জাতীয়তাবাদের চেতনা, পুলওয়ামার মতো ঘটনা, পাকিস্তানবিরোধী অ্যাজেন্ডা নেই, তাই অন্যান্য ব্যর্থতা ঢাকতে ধর্মীয় কার্ডকে বেশি ব্যবহার করতে হচ্ছে বিজেপিকে।
অন্য দিকে বিরোধীদের জোট ‘ইন্ডিয়া’র কণ্ঠস্বরেও শোনা যাচ্ছে আত্মবিশ্বাসের সুর। দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও অনেকেই বলছেন, চারশো তো দূরের কথা, বিজেপি গতবারে তাদের জেতা ৩০৩টি আসন ধরে রাখতে পারবে কি না, সেটা নিয়েও এখন সন্দেহ দেখা দিচ্ছে।
ভারতে গত ১০ বছরের মোদি সরকারের শাসনামলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভ্রান্ত ধারণা, শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, রুপির নিম্নমুখী মান এবং করোনাকালের অব্যবস্থাপনাÑসবই প্রকট হয়ে উঠেছে। এসব জাতীয় ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে বিজেপি ধর্মান্ধতা ও হিন্দুত্ববাদের বিষয়টিতেই জোর দিচ্ছে। মোদি সরকারের এ প্রয়াসে কিন্তুসাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি।
অনেকেই মনে করছেন যে, এই নির্বাচনে কতগুলি ইস্যু বড় রকমের প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য ভারতের মুসলমান ভোটারদেরকে একাট্টা করেছে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি তা বুঝতে পেরেছে। আর এ কারণে এবার মুসলিম ভোটারদেরকে ভোট দানে বাধা দেওয়া হচ্ছে-এমন অভিযোগও উঠেছে বিভিন্ন এলাকা থেকে। দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণে ট্রেন বন্ধ রেখে মুসলিম ভোটারদেরকে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি বলে ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর প্রকাশিত হয়েছে।
লোকসভা নির্বাচনে মোদির নেতৃত্বে কেমন ফল করতে পারে বিজেপি? পূর্বাভাস দিলেন ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর (পিকে)। যদিও ধারাবাহিক ভাবে অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের সম্ভাব্য ফল নিয়ে নানা পূর্বাভাস দিয়ে চলেছেন তিনি।
মঙ্গলবার এনডিটিভি-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পিকে বলেন, ‘‘বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট এ বারের লোকসভা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ঠিকই পাবে। কিন্তু নিরঙ্কুশ জয় নাও পেতে পারে। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি র নেতৃত্বে বিজেপি ৩০৩টি আসনে জিতেছিল। এ বারও তাদের প্রাপ্ত আসন তার আশপাশেই থাকবে। আসন সংখ্যা বেশি না পেলেও বিজেপি জোট যে ক্ষমতায় ফিরবে বলে মনে করেন ভোটকুশলী (পিকে)।
এদিকে জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে ক’দিন আগে প্রথম সাংবাদিক বৈঠকেই দিল্লীর মূখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল মনে করিয়ে দিয়েছেন, আগামী বছরেই কিন্তু নরেন্দ্র মোদি পঁচাত্তরে পা রাখবেন – যেটা অলিখিতভাবে তার নিজেরই বেঁধে দেওয়া রাজনৈতিক অবসরের বয়স। কেজরিওয়াল তাই প্রশ্ন তুলেছেন, “আগামী বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর তো মোদিজিকেও (তার নিজের করা নিয়ম অনুযায়ী) অবসরে যেতে হবে। তাহলে তার পর কে?”
মোদি সামনের বছর অবসরে গেলে মন্ত্রিসভায় অলিখিত দু’নম্বর অমিত শাহ-ই দায়িত্বে আসবেন, এমনও ইঙ্গিত করেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। এমন কী তৃতীয়বার মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে দু’মাসের মধ্যে উত্তরপ্রদেশের দায়িত্ব থেকে যোগী আদিত্যনাথকে সরানো হবে বলেও মন্তব্য করেছেন।
বিজেপির অভ্যন্তরে ‘মোদির উত্তরাধিকারী বিতর্ক’কে উসকে দেওয়াই যে তার উদ্দেশ্য ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেটা যে বেশ সফলও হয়েছে, তা বোঝা গেছে অমিত শাহ বা রাজনাথ সিংয়ের মতো দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আপ নেতার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে।
মোদি ২০১৪ সালে যখন প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসেন তখন লালকৃষ্ণ আডভানি বা মুরলীমনোহর জোশীর মতো দলের প্রবীণ নেতাদের ক্ষমতার বাইরে রাখতেই অবসরের নিয়ম চালু করেন। ২০১৪ তে আডভানি ও জোশী দুজনেই কিন্তু লোকসভা ভোটে জিতে এমপি হয়েছিলেন। দুজনেই ততদিনে আশি পেরিয়ে গেছেন, এবং এই নতুন নিয়মের চক্করে পড়ে তাদের কারওরই মোদির ক্যাবিনেটে ঠাঁই হয়নি।
নরেন্দ্র মোদি টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় আছেন সেটি এখন উগ্র হিন্দুত্ববাদী মনোভাবের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তাছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষ বিশেষ করে কৃষকদের নাজুক পরিস্থিতি নরেন্দ্র মোদি ম্যাজিককে ফিকে করে দিয়েছে। অনেকেই এই নির্বাচনে যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে সেই পূর্বাভাস শেষ পর্যন্ত সফল হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
প্রথম দফা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখে প্রায় সব সভায়ই শোনা যাচ্ছিল, তিনি ‘৪০০-পার’ আসন চাইছেন দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশবাসীর মঙ্গলের জন্য। যেমন ১৬ এপ্রিল, সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, গয়ার সভায় মোদী বলেছেন ‘৪০০-পার’ প্রয়োজন বিকশিত ভারতের স্বার্থে।
কিন্তু প্রথম দুই দফা ভোটের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণে এই পরিবর্তন? সব কারণ বাইরে থেকে দেখা যায় না। ফলে বিজেপিকে ফিরে যেতে হয়েছে তাদের চিরকালীন হিন্দু-মুসলিম ইস্যুতে। প্রধানমন্ত্রীর প্রথম দফার পরের ভাষণে তার ছাপ রয়েছে। দ্বিতীয় কারণ, ভোট কম পড়ছে ২০১৯-এর তুলনায়।
অনেকে মনে করছেন যে, ২০০৪ সালে ভারতের চতুর্দশ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ম্যাজিক দেখিয়েছিল। সে সময় বিজেপির ইন্ডিয়ার সাইনিং শ্লোগানের আড়ালে সকলে জয়ের সম্ভাবনা দেখেছিল অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি জোটের। কিন্তু সেই নির্বাচনে সকল জরিপকে মিথ্যে প্রমাণ করে কংগ্রেস বিজয়ী হয়েছিল। এবার নির্বাচনে তেমন কোন ফলাফল হবে কিনা তা নিয়ে নানা রকম জল্পনা কল্পনা চলছে।
তবে নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা তেমন কোন সম্ভাবনা দেখছেন না। বরং তারা মনে করছেন যে, ভারতে শেষ পর্যন্ত বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ জোটই বিজয়ী হবে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এবং তার নেতৃত্বে জোট যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ট আশা করেছিল সে সংখ্যাগরিষ্ট অনেকটাই কমে যাবে। তবে এই নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির এনডিএ জোট বিজয়ী হলেও নরেন্দ্র মোদির ম্যাজিক অনেকটাই ফিকে হয়ে যাকে বলেই মনে করা হচ্ছে।
এই নির্বাচনের ফল যা-ই হোক, ভারতের রাজনীতির মানচিত্রে ইতিমধ্যেই একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে এই ষষ্ঠ দফার ভোট। সেটা হল, গণতন্ত্রের একটি আবশ্যিক শর্ত হল শক্তিশালী বিরোধী দল। গত দশ বছরে যার অস্তিত্বই ছিল প্রায় না থাকারই মতো। সেই শূন্যতা পূরণ হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে এবারের ভোটের গতি প্রকৃতিতে।
লেখক: সাংবাদিক