
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রিন্স
পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই নানা ঘটনাপ্রবাহের ঐতিহ্য বহন করে আসছে পবিত্র মহররম মাস। বিশেষত কারবালার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মহররম মাস আরও বেশি স্মরণীয় হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়।
১০ মহররম ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শাহাদতের অমিয় সুধা পান করেন হজরত হোসাইন (রা.)। হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম তাৎপর্যমণ্ডিত একটি মাস। মুসলিম ইতিহাসে এ মাসটি বিভিন্ন কারণে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
আসমান-জমিন সৃষ্টিসহ পৃথিবীতে অনেক স্মরণীয় ও যুগান্তকারী ঘটনা এ মাসের ১০ তারিখে অর্থাৎ পবিত্র আশুরার দিন সংঘটিত হয়েছিল। মহররম সংশ্লিষ্ট ২০টি ঘটনার সংক্ষিপ্ত শিরোনাম নিম্নে তুলে ধরা হলো-
১. আকাশ জমিন পাহাড়-পর্বত সব কিছু সৃষ্টি। ২. আদম (আ.)-এর সৃষ্টি । ৩. নূহ (আ.) মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ। ৪. হজরত ইবরাহিম (আ.) নমরুদের প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তিলাভ। ৫. দীর্ঘ ১৮ বছর রোগ ভোগের পর হজরত আইয়ুব (আ.)-এর দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তিলাভ। ৬. হজরত সুলাইমান (আ.)কে পৃথিবীর রাজত্ব দান। ৭. হজরত ইউনুস (আ.)কে ৪০ দিন পর দজলা নদীতে মাছের পেট থেকে উদ্ধার। ৮. হজরত মূসা (আ.) ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা। ৯. হজরত ঈসা (আ.)-এর পৃথিবীতে আগমন এবং জীবতাবস্থায় আসমানে উত্তোলন। ১০. হজরত ইদ্রিস (আ.)কে আসমানে উত্তোলন। ১১. হজরত দাউদ (আ.)কে বিশেষ সম্মানে ভূষিত। ১২. খায়বার যুদ্ধের বিজয় অর্জন। ১৩. মাদায়েন এবং কাদিসিয়ার যুদ্ধে বিজয় অর্জন। ১৪. হজরত আদম (আ.)-এর জান্নাতে প্রবেশ। ১৫. হজরত আদম (আ.) কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ এবং গুনাহ মার্জনার পর তার সঙ্গে হাওয়া (আ.)-এর পুনঃসাক্ষাৎ লাভ। ১৬. হজরত নূহ (আ.) কে তুফান ও প্লাবন থেকে পরিত্রাণ প্রদান। ১৭. হজরত সোলায়মান (আ.) কে হারানো বাদশাহি ফিরিয়ে দেওয়া। ১৮. হজরত ইয়াকুব (আ.) কর্তৃক হারানো পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ। ১৯. প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা শরিফ থেকে হিজরত করে মদিনা শরিফে আগমন। ২০. হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তার ৭৭ ঘনিষ্ঠজন স্বৈরশাসক ইয়াজিদের সৈন্য কর্তৃক কারবালা প্রান্তরে নির্মমভাবে শাহাদতবরণ।
মহানবী (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য চান্দ্রমাসের হিজরি সন গণনার সূচনা হয়। আরবি বর্ষপঞ্জির সঙ্গে পৃথিবীর ১৬০ কোটি মুসলমানের ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি ও ইসলামি আচার-অনুষ্ঠান সর্বোপরি ইবাদত-বন্দেগির বিষয়টি সরাসরি সম্পৃক্ত। হিজরি সন ইসলামের ইতিহাসের একটি মৌলিক ও গৌরবোজ্জ্বল দিক এবং মুসলমানদের অশেষ ঐতিহ্যের অবদানে মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ হওয়ায় পৃথিবীর সর্বত্র সমানভাবে সমাদৃত। হিজরি সন ইসলামের ইতিহাসে একটি মৌলিক ও গৌরবোজ্জ্বল দিক এবং মুসলমানদের অশেষ ঐতিহ্যের অবদানে মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ হওয়ায় পৃথিবীর সর্বত্র সমানভাবে সমাদৃত। নবী করিম (সা.) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে মদিনায় হিজরত করেন, কিন্তু এর প্রস্তুতি ও আকাবার শেষ বায়আতের পরবর্তী সময়ে হিজরতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে প্রথম যে চাঁদটি উদিত হয়েছিল, তা ছিল মহররম মাসের। অন্যান্য সাহাবায়ে কিরামের হিজরত মহররম থেকে শুরু হয়েছিল, তাই হিজরি সনের প্রথম চান্দ্রমাস মহররম থেকে ধরা হয়।
হিজরি সনের সঙ্গে মুসলমানদের বিশেষ ঐতিহ্য নিহিত রয়েছে। যদিও হিজরতের সময়কাল থেকে হিজরি সন বা চান্দ্রবর্ষ গণনা আরম্ভ হয়, কিন্তু এ পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে চান্দ্রমাসের গণনা শুরু হয়েছে। আসমান ও জমিন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে মাস গণনায় মাস ১২টি, তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত, এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার কোরো না।’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৩৬)
আরবি চান্দ্রবর্ষ তথা হিজরি সনের প্রথম মাস হলো মহররম। ‘মহররম’ শব্দের অর্থ অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। ইসলামে মহররম মাসটি অত্যন্ত মর্যাদাবান ও ফজিলতময়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা যে চারটি মাস সম্মানিত বলে ঘোষণা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর মুখ নিঃসৃত অমিয় বাণীর মাধ্যমে তা সুস্পষ্ট ও নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। বিদায় হজের ভাষণে সম্মানিত মাসগুলোকে চিহ্নিত করে তিনি বলেছেন, ‘তিনটি মাস হলো ধারাবাহিক জিলকদ, জিলহজ ও মহররম, অপরটি হলো রজব।’ (বুখারি)
সৃষ্টির আদিকাল থেকেই চান্দ্রমাসের হিসাব মহান আল্লাহর গণনায় রয়েছে। যুগ যুগ ধরে মানুষ চান্দ্রমাসের হিসাব করে চলেছে। প্রাচীনকাল থেকে পূর্ববর্তী সব নবী-রাসুলের শরিয়তে ১২ চান্দ্রমাসকে এক বছর গণনা করা হতো এবং তন্মধ্যে জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব—এ পবিত্র চারটি মাসকে বরকতময় ও সম্মানিত মনে করা হতো। এ মাসগুলোকে ‘আশ-শাহরুল হারাম’ বা অলঙ্ঘনীয় পবিত্র মাস বলা হতো। এ চারটি মাসে যেকোনো ইবাদতের সওয়াব বৃদ্ধি পায়। তেমনি এ সময়ে পাপাচার করলে এর ভয়াবহ পরিণাম ও কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়। পূর্ববর্তী শরিয়তসমূহে এ মাসগুলোতে সব ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, মারামারি, খুনোখুনি প্রভৃতি নিষিদ্ধ ছিল।
ইসলামের ইতিহাসে মহররম মাসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিভিন্ন কারণে অশেষ মর্যাদাপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। প্রাক-ইসলামি যুগেও মহররমের ঐতিহ্য বিদ্যমান ছিল। অফুরন্ত বরকত ও তাৎপর্যমণ্ডিত মহররম মাসে বহু নবী-রাসুল ইমানের কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে মুক্তি ও নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন। কারবালাসহ অসংখ্য তথ্যবহুল ঐতিহাসিক ঘটনা এ মাসে সংঘটিত হয়েছিল। ১০ তারিখ আশুরার সঙ্গে পুরো মহররম মাসের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে। রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে পবিত্র আশুরার দিনে রোজা রাখা ফরজ ছিল। পরে তা রহিত করে মাহে রমজানের রোজা ফরজ করা হয়। ইসলাম-পূর্বকালে বিভিন্ন জাতি নানা কারণে আশুরার দিন রোজা রাখত। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করে দেখতে পেলেন যে ইহুদিরা মহররমের ১০ তারিখ আশুরা দিবসে রোজা রাখছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কোন দিন যাতে তোমরা রোজা রেখেছ? তারা বলল, এটা এমন এক মহান দিবস, যেদিন আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর সম্প্রদায়কে নাজাত দিয়েছিলেন, ফিরআউনকে তার সম্প্রদায়সহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তাই হজরত মুসা (আ.) শুকরিয়া হিসেবে এদিন রোজা রেখেছেন, এ জন্য আমরাও রোজা রাখি। এ কথা শুনে নবী করিম (সা.) বললেন, ‘তোমাদের চেয়ে আমরা হজরত মুসা (আ.)-এর অধিকতর ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তী।’ অতঃপর তিনি রোজা রাখলেন এবং অন্যদের রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)
নবী করিম (সা.) বাকি জীবনে এদিন রোজা রাখতেন। মদিনায় আগমনের পর রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার পর তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমি আশুরার দিন রোজা রাখতে আদিষ্ট ছিলাম, অতএব এখন তোমাদের কারও যদি ওই দিন রোজা রাখতে ইচ্ছা হয়, তবে তা রাখতে পারো।’ আশুরার দিন রোজা রাখলে ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য হয়ে যায় বিধায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আগের দিন বা পরের দিন আরেকটি রোজা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুমিন মুসলমান ১০ মহররম আশুরা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে এদিন ঐচ্ছিক রোজা পালন করে। আশুরার দিন নফল রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলে তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘এ রোজা বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হয়ে থাকে।’ (মুসলিম ও তিরমিজি) অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘যে ব্যক্তি আশুরার রোজা রাখবে, আল্লাহ তার এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।
তাই আসুন, আল্লাহর দরবারে বিনীত প্রার্থনা করি তিনি যেন মহররম মাসের ইসলামি ঐতিহ্য, গুরুত্ব ও মর্যাদা অনুধাবন করে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অশেষ সওয়াব হাসিলের তাওফিক দান করেন এবং ঐতিহাসিক কারবালার মর্মস্পর্শী ঘটনা স্মরণে প্রতিটি মুসলমানকে ইমানি চেতনা শক্তিতে বলীয়ান ও তেজোদীপ্ত হওয়ার মানসিকতা দান করেন।
লেখক : সাংস্কৃতিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, শিফট ইনচার্জ (প্রভাতী), ঐতিহ্যবাহী আহমেদ বাওয়ানী একাডেমী স্কুল এন্ড কলেজ।