
এ বি সিদ্দিক
মামা,
আপনি দীর্ঘ বিরতিতে মনক্ষুন্ন, কিছুটা হতাশ, রাগ আর অভিমানে বিরাগভাজন। তবে এরই মধ্যে রয়েছে মায়াভরা হৃদয়ের টান। “শাসন করা তাকে সাজে, সোহাগ করে যে” । আসলে মামা,
নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে,
রয়েছ নয়নে নয়নে,
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে,
হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।
লক্ষ্যহীন, কক্ষচ্যুত গ্রহ কণিকার মত অবস্থায় পড়ার কারণে আমার এ দীর্ঘসূত্রতা। ফলে যোগাযোগে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাটা পড়েছে। যার কারণে পাঠক সমাজের কাছে প্রশ্নবাণে জর্জরিত, যা নিতান্ত ন্যায়সঙ্গত। মামা-ভাগিনার তথ্যবহুল রম্য আলোচনা থেকে পাঠক সমাজ বঞ্চিত এবং অনেকাংশে তারা উৎকণ্ঠিত। তবে আমি এজন্য অনুতপ্ত এবং লজ্জিত। মনের মাঝে অতৃপ্ত বাসনা আর চিন্তা-চেতনা নিয়ে লেখা থেকে দূরে থাকা বা দূরে রাখা সত্যিই বেদনাদায়ক এবং কষ্টদায়ক। আপনার আশীর্বাদ আর পাঠক সমাজের অকুণ্ঠ সমর্থন আমার লেখার অন্যতম প্রেরণা, শক্তি ও সাহস। ফলে ত্রিমুখী শূন্যতা থাকলেও পূর্বের মত নিয়মিত লেখার মাধ্যমে পাঠক চাহিদার পূর্ণতা আনার চেষ্টা করছি।
নোবেল লরিয়েট অর্থনীতিবিদ ড. ইউনুসের বিশ্ব নন্দিত তিন শূন্য [শূন্য দরিদ্রতা, শূন্য বেকারত্ব, শূন্য কার্বন নির্গমন] থিওরির মত মামা, ভাগিনা আর পাঠকসমাজ [তিন শূন্য]- সর্ব-মহলে খোলা চিঠির সুনাম, কদর এবং চাহিদা আরও বাড়বে বলে আশাবাদী।
মামা,
ক্ষমতার লোভ আর অহংকারে একজন মহাশক্তিধর সরকারপ্রধান কিভাবে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়, তার সচিত্র নমুনা তো আমরা মামা-ভাগিনা নয়ন ভরে দেখেছি। গুম, খুন, আয়নাঘরের নির্যাতন, পিলখানা হত্যাকান্ড, শাপলা চত্বরে গণহত্যা, ‘মায়ের ডাক’ সংস্থার স্বজন-হারাদের করুণ আর্তনাদ, ব্যাংক-লুট, কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার, ভোটারবিহীন নির্বাচন, সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা এবং অহমিকা ক্ষমতা হারানোর মূল কারণ বলে বিক্ষুব্ধ জনগণ মনে করে। এছাড়া জুলাই-আগস্টে গণহত্যায় ছাত্রজনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। যার ফলে শেখ হাসিনার বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠে।
মামা,
আপনার মাধ্যমে বিগত চিঠিগুলোতে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের দুর্নীতি আর সকল অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরে সতর্ক ও হুঁশিয়ার করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেখ হাসিনা কোন কর্ণপাত করেনি। আসলে, কাঙালের কথা বাসি হলেও ফলে। অন্যদিকে, তোষামোদকারীরা শেখের বেটিকে নানাভাবে ভুল বুঝিয়ে এবং নিজেদের আখের গুছিয়ে তাকে অপমানজনক-ভাবে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছে, যা আওয়ামী লীগের মতো একটি শক্তিশালী সংগঠনের জন্য করুণ ও মর্মান্তিক ইতিহাস। এ ঘটনার ফলে হাজার হাজার নেতাকর্মী দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে এবং পালিয়ে বেড়াচ্ছে। লজ্জায় তারা বাকরুদ্ধ। কথা বলার কোন সাহস, শক্তি, যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেনা। অনেকে হামলা-মামলার শিকার। অনেকে নির্জন কারাগারে বিচারের অপেক্ষায়। দলের সকল কার্যক্রম বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৪৯ সালে গঠিত দলটির অবস্থা এখন বেওয়ারিশ লাশের মত। এ দল একই অবস্থায় পড়েছিল ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর পর। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু জাতীয় সরকার গঠন না করে একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে দেশে এক অরাজকতা সৃষ্টি করেছিল। বাকশাল গঠন করে বাক স্বাধীনতা হরণ করে একদলীয় শাসন কায়েম করে। তখনকার সময়ের রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার, ’৭৪ এর দুর্ভিক্ষ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি খুঁজে পায়নি। আওয়ামী লীগ থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাল। মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, উড়াল সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ যুগান্তকারী উন্নয়ন কর্মকান্ডের পরও সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সকল উন্নয়ন চাপা পড়ে যায়। নিবেদিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সমর্থকেরা আওয়ামী লীগের নাম নিতে এখন লজ্জাবোধ করে। ব্যাংকগুলো টাকা-শূন্য এবং অধিকাংশ ব্যাংক খেলাপি ঋণে জর্জরিত। হাজার হাজার ব্যাংক কর্মচারী চাকরি হারাচ্ছে। ব্যাংকগুলোর কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। শেষের দিকে শেখ হাসিনার এমন অবস্থা হয়েছিল যেন ‘জয়কালে ক্ষয় নেই, মরণকালে ঔষধ নেই’ । প্রায় ষোল বছর শাসন করে এবং একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের সভাপতি হয়েও দেশ ছাড়ার প্রস্তুতির জন্য ১ ঘণ্টার বেশি সময় পায়নি। ৫ মিনিটের একটি ভাষণ দেওয়ারও সুযোগ হয়নি। তারপরও তার এ অপশাসনের জন্য অনুতপ্ত নয়। এমন কি ভুল স্বীকার করতে আজও অপ্রস্তুত। আসলে কি আশায়, কি নেশায়, কি ভরসায় এবং কোন যোগ্যতায় আবার দেশে আসতে চান তা বুঝে আসেনা। ইতিহাসের বড় শিক্ষা হল ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ভবিষ্যতে কেউ শিক্ষা নেবে কিনা তাও সন্দেহ। কারণ, বিগত ৫৪ বছর থেকে ক্ষমতার পালা বদল দেখে আসছি। আন্দোলন, সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের পতন দেখেছি।
মামা,
শুভাকাঙ্খীদের নিষেধ থাকার পরও জীবন ঝুঁকি নিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরে সরকারকে সতর্ক করতে গিয়ে কঠিন নির্যাতনের শিকার, এমনকি চাকরীচ্যুত। নিপীড়ন, নির্যাতনের পর সত্য প্রবচন আরও শাণিত হয়েছিল। আসলে আঘাত না আসলে প্রতিবাদের ভাষার বিকাশ ঘটেনা। প্রেমিকা হেলেনের কারণে হেলাল হাফিজ এ দেশের শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে একজন। হেলেন কে না পাওয়ার কারণে “যে জলে আগুন জ্বলে ” কাব্য গ্রন্থটি লিখে চির কুমার কবি হেলাল হাফিজ বিখ্যাত হয়েছেন। প্রিয়তমা হেলেনের উদ্দেশ্যে লিখেছেন-
হয়তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি,
নয় তো গিয়েছি হেরে,
থাক না ধ্রুপদী অস্পষ্টতা,
কে কাকে গেলাম ছেড়ে ।
চরম দরিদ্রতার কারণে কাজী নজরুল দ্রোহ ও বিদ্রোহের কবি। তিনি লিখেছেন-
হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান,
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।
অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমিও আজ ভাগিনার খোলা চিঠি-এর মত জনপ্রিয় কলামের লেখক হতে পেরেছি। পাঠক মহলেও আজ সমাদৃত।
মামা,
কথায় বলে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। ছাত্রদের কোটা-বিরোধী আন্দোলন সময়ের সাথে এক দফাতে রূপ নিয়েছে। আসলে জোর করে ক্ষমতায় থাকা যায়না। ২০১৪ সালের ভোটার-বিহীন নির্বাচন, ২০১৮ সালের দিনের ভোট রাতে এবং ২০২৪ সালের আমি-ডামি মার্কা নির্বাচন করে গণতন্ত্রের মানসকন্যা গণতন্ত্রের কবর রচনা করেছেন। স্বেচ্ছাচারিতা আর বিনা বিচারে মানুষ হত্যার কারণে মানুষের মনে প্রতিবাদ আর প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠে। ছাত্র-জনতা প্রতিবাদের দুর্গ গড়ে তোলে, মরণকে সহাস্যে বরণ করে নেয়। একজন মারা গেলে আরেকজন মাথা তুলে দাঁড়ায়। বীর সন্তান ‘আবু সাঈদ’ ও ‘মুগ্ধ’-রা বুক পেতে গুলি নিয়ে আন্দোলন চাঙ্গা করে তোলে এবং শেখ হাসিনার বিদায়কে ত্বরান্বিত করে। আসলে, অহংকার পতনের মূল। ক্ষমতা আর চেয়ার মানুষকে অন্ধ করে ফেলে। জালিম সরকারের নিপীড়ন, নির্যাতন বেশিদিন টিকে থাকেনা। হিটলার, মুসোলিনিও টিকে থাকতে পারেনি। ফ্যাসিস্ট সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাও একই অবস্থার শিকার।
মামা,
আমি গদ্যে-পদ্যে, গল্প-কবিতায়, জল্পনা-কল্পনায়, আকার-ইঙ্গিতে ভাগিনার খোলা চিঠির মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠীকে বুঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। সবই নিষ্ফল। সেই সময়ে আমার লেখা চিঠিগুলো যুগের সাক্ষী, দালিলিক প্রমাণ এবং সময়ের জিজ্ঞাসা। দাম্ভিকতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচারহীনতা, দুর্নীতি, দুঃশাসন আর বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের মৃত্যু নিয়ে নিষ্ঠুর রসিকতা স্বৈরাচার সরকারের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। যার ফলাফল ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান।
মামা,
আমাদের অবস্থা হল অন্ধকার ঘরে কালো বিড়াল খোঁজার মতই। এক স্বৈরাচারের পতনের পর নব্য স্বৈরাচারের জন্ম হয়। এরা দেশ শাসন করে। জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়না। বিগত সময়ে শাসনে-শোষণে দেশটা মহা শ্মশানে পরিণত হয়েছে। পরিবারতান্ত্রিক পদ্ধতির শাসন ও অপশাসনের পরিণতিতে দেশের আজ করুন ভগ্নদশা। লুটতরাজের রাজনীতি আর দেউলিয়া অর্থনীতির কারণে মানুষ চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে। কৃষি-খাত, গার্মেন্টস-খাত আর বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সই বর্তমানে দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি।
মামা,
মানুষের মনে শান্তি নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, চাঁদাবাজ, দখল-বাজ এবং মব ভায়োল্যান্সের কারণে মানুষ দিশেহারা। আইন- শৃঙ্খলার চরম অবনতি। কথায় কথায় দাবী আদায়ের নামে রাস্তাঘাট অবরোধে মানুষের অসহনীয় দুর্ভোগ। নির্বাচন, সংস্কার, বিচার এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে মতানৈক্য। মানুষ হয়রানির শিকার। ইউনুস সরকার বিগত ১ বছরে আশানুরূপ পরিবর্তন আনতে পারেনি। বিদেশে টাকা পাচার, একচ্ছত্র লুটপাট অনেকখানি বন্ধ করতে পারলেও মানুষকে তেমন সুখী করতে পারেনি। মুদ্রাস্ফীতি কমাতে পারেনি। অর্থনীতির অবস্থা সংকটাপন্ন । যে জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতা নিয়েছেন তা এখন হিমাংকে। অবস্থা হল ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ । চাঁদাবাজি আর দখলবাজির জন্য বিএনপির ওপর মানুষ বেজায় নাখোশ। দলের নেতা কর্মীরা তারেক জিয়ার কথা শুনছে না। সবাই আখের গোছানোর চেষ্টা করছে। তারেক জিয়ার বিবিসির সাক্ষাৎকারে তার কথাবার্তা দেশবাসীর মনে আশার সঞ্চার করলেও মানুষ ভরসা পাচ্ছেনা। এদিকে, জামায়াত নেতা এডভোকেট শিশির মনির রোজা আর পূজা কে এক করে ফেলার কারণে মানুষ এখন জামায়াতে ইসলামী নিয়ে ভিন্ন চিন্তা করছে। অথচ ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের ভূমিধস বিজয়ে রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী মানুষের সুনজরে আসে। তা এখন কারণে অকারণে প্রশ্নবিদ্ধ। তবে ভোটের মাঠে নির্বাচনী কৌশল, দলের যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন এবং সুসংগঠিত জামায়াতে ইসলামীকে মোকাবেলা করার মত সক্ষমতা বা কৌশল অর্জন করতে না পারলে বিএনপির ক্ষমতা যাওয়ার সকল আশা আকাঙ্খা বুমেরাং হয়ে যাবে। নেতা কর্মীদের কাছে শেখ হাসিনা যেমন চোখের মণি ছিল, বর্তমানে অনেকাংশে চক্ষুশূল হয়ে গেছে। কারণ, কর্মীদের দেশে রেখে আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে শেখ হাসিনার বিদেশ পলায়ন কেউ এখন ভাল চোখে দেখছে না।
মামা,
দেশ স্বাধীনের ৫৪ বছর কেটে গেল। আসলে কেউ কথা রাখেনি। কেউ কথা রাখে না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত সেই কবিতাটির নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় বলতে গেলে-
কোনো গা কথা রাখে ন,
তেত্রিশ বচ্ছর কাডি গেছে গই,
কোনো গা কথা রাখে ন,
মামার গো বাড়ির নাদের আলী কইছিল,
বড্ড অও ভাইছা তোয়ারে আই তিন প্রহরের বিল দেখাতে লই যাইয়ুম,
হিয়েনে পদ্ম হুলের মাথাত হাপ (সাপ) আর ভৌরা খেলা করে,
নাদের আলীরে, আই (আমি) আর কত বড্ড অইতাম,
আঁর মাথা এ ঘরের চাল ছেদা করি ঐ আকাশ ছুঁইলে হের হরে দিনি তুই আঁরে তিন প্রহরের বিল দেখাবি।
অর্থাৎ, নাদের আলীও কথা রাখেনি। আসলে রাজনৈতিক দলগুলোর কোন অনুশোচনা, বিবেক, বিবেচনা, লজ্জা, শরম কিছুই নেই। এরা কথা দিয়ে কথা রাখে না। জনগণের সাথে শুধু প্রতারণা করে। জনগণকে নিয়ে খেলা করে। জনগণ যে বাড়া ভাতে ছাই দিতে পারে সেটা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেনা। গত ৫ আগস্ট জনগণ গণভবনে ঢুকে বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছিল, তারপরও এখনো হুশ-জ্ঞান হয়নি রাজনৈতিক দলগুলোর। কেউ বলে শাপলা মার্কা চাই, কেউ বলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চাই আর কেউ বলে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন। এগুলো তামাশা ছাড়া কিছু নয়। এমনকি জুলাই সনদ নিয়ে নানা টালবাহানা। এদের প্রতারণা দেখতে দেখতে জনগণ অস্থির। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন ‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাইনা – আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই’। পরে তিনি রাষ্ট্রপতি হলেন (শপথ ছাড়া)। পরবর্তীতে আবার প্রধানমন্ত্রীও হলেন। একসময় সব দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল নামে একটি মাত্র দল বানালেন- যার সর্বময় ক্ষমতা রাখলেন নিজের হাতে। নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা পরিবর্তনের কোন সুযোগ রাখলেন না। একটি সহিংস গণঅভ্যুত্থানের অবস্থা নিজেই তৈরি করেছিলেন।
১৯৭৬ সালে ১লা মে জিয়াউর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মে দিবস পালন উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমি রাজনীতিবিদ নই- আমি একজন সৈনিক- আমি ব্যারাকে ফিরে যাব’। সেনাবাহিনীতে চাকরি করা অবস্থায় তিনি একটা নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি হলেন। বিএনপি নামে একটা দল গঠন করলেন। তারপর নিজেই নিজেকে আহ্বায়ক করে ৭৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করলেন।
১৯৮৬ সালে স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেন। খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৫ দফা দাবীর ভিত্তিতে হয় এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। শেখ হাসিনা ১৯ মার্চ চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে ঘোষণা দিলেন যে, এরশাদের পাতানো নির্বাচনে যে অংশ নিবে সে জাতীয় বেঈমান হবে।
হাসিনা জামায়াতকে নিয়ে এরশাদের সেই পাতানো নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করলেন। এরশাদের সাথে লং ড্রাইভে গেলেন। কথা রাখেননি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় দুই নেত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যে কাজগুলো তারা করবেন তা হল- সকল কালাকানুন বাতিল, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বেতার-টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ কে আলাদা করা। ক্ষমতায় গিয়ে তারা কিছুই করেননি। তিন জোটের রূপরেখা কেউ অনুসরণ করেননি। কেউ দুর্নীতির বিচার করেননি। এরশাদ ক্ষমতায় এসেই কৃচ্ছ্রতাসাধনের নামে সচিবালয়ে সাইকেল চালিয়ে আসলেন, আসলে ভাঁওতাবাজি। এক সময়ে বিশ্ব বেহায়া খেতাব পেয়েছেন এবং ‘৯০ এর গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারালেন। শেখ হাসিনা সর্বদাই বলতেন তার চাওয়া-পাওয়া কিছুই নেই। দেখা গেল পূর্বাচলে ১০ কাঠা জমির লোভই সামলাতে পারেননি। ১ টাকার বিনিময়ে গণভবন লিখিয়ে নিতে দ্বিধা বোধ করেননি। “শেখের বেটি পালায় না” অবশেষে এ কথাটিও রাখতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। এদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি ও মন্ত্রীবর্গ শপথের পরপরই শপথ ভঙ্গ করে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন অহরহ। নেতারা এ পর্যন্ত কোন কথা রাখেননি। বাকী জীবনেও যে কথা রাখবেন তার কোন বিশ্বাস নেই। শেখ হাসিনা বলতেন খালেদা জিয়া এতিমের হক মেরে খেয়েছেন। অথচ উনি ২৮ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন । তার পরিবার ৯টি প্রজেক্টে ৮০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন (সূত্র- প্রথম আলো)। তার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক বলে সাংবাদিক সম্মেলনে নিজের মুখে বলেছেন। তাহলে তিনি দুর্নীতিকে কিভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন এদেশের জনগণ সহজেই বুঝতে পেরেছেন। জনগণের সাথে প্রতারণা করে তিনটি প্রহসনের নির্বাচন করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন।
মামা,
পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের- নিমন্ত্রণ আর কবর, রবি ঠাকুরের- সাধারণ মেয়ে, নজরুলের- বিদ্রোহী, জীবনানন্দ দাসের- বনলতা সেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের- কেউ কথা রাখেনি, আল মাহমুদের- সোনালী কাবিন, শামসুর রাহমানের- স্বাধীনতা তুমি, রফিক আজাদের- ভাত দে হারামজাদা, বন্দে আলী মিয়াঁর- কলমিলতা, মাইকেলের- কপোতাক্ষ নদ, সৈয়দ শামসুল হকের- পরানের গহীন ভিতর – এ কবিতাগুলোর মাধ্যমে বাঙ্গালী তার ন্যায্য পাওনা আদায়ে সাহস শক্তি নিয়ে অনেক সোচ্চার হয়েছে। জাতিসত্তার ইতিহাস, আবহমান গ্রাম বাংলার রূপ-প্রকৃতি, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, খেটে খাওয়া মানুষের জীবন-জীবিকা, শৃঙ্খল-মুক্ত হওয়ার দিক নির্দেশনা, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ প্রেমের বীরোচিত ইতিহাস জানার সুযোগ হয়েছে। গ্রামবাংলার দুঃখিনী মায়ের মায়া-মমতা, হাসি-কান্না কবিতার বর্ণমালায় বর্ণনা উঠে আসে। কবিতার দেশ, কবির দেশ, সাধু-সন্ন্যাসী, আলেম-ওলামা আর পীর-বুজুর্গের দেশ বাংলাদেশ। কবিতার মাধ্যমে দেশকে ভাল লাগার অন্যরকম অনুভূতি জাগে। ঝড়-বৃষ্টি, তুফান, বন্যা, খরা, সুনামি আর জলোচ্ছ¡াস- প্রকৃতির এ নিষ্ঠুর শাসনও বাংলার মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারেনা। দেশপ্রেম আর মানব প্রেমের অপূর্ব স্রোতধারায় সকল অভাব অভিযোগ আর বাধা বিপত্তি মানুষ ভুলে যায়। পাখি-ডাকা ভোর, বৃষ্টি-ভেজা রাত, শিশির-ভেজা গ্রামের মেঠোপথ, কৃষ্ণচূড়ার রঙিন স্নিগ্ধতা, গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুর-ভরা মাছ আর শান বাধানো ঘাটের ঐতিহ্য ও গৌরব চোখে ভেসে উঠে। ফসলের মাঠ, কৃষাণীর নির্মল হাসি, রাখালের বাঁশীর সুর, জারি-সারি, পালা গান আর পাল তোলা নৌকার মাঝির ভাওয়ালী সুরের মূর্ছনায় আনন্দে ভরে উঠে মন। কৃষক, শ্রমিক, কামার-কুমার, তাঁতি আর জেলে তাদের অভাব-অভিযোগ ভুলে গিয়ে আনন্দে মেতে উঠে। হিন্দুদের পূজা-পার্বণ আর মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব যথারীতি পালনের মাধ্যমে উভয়ের মাঝে যে মিতালী ভাব সৃষ্টি হয় এতে বুঝা যায় যে বাংলার সোনার মানুষগুলো সোনার মত। তখন প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সুরে তাল মিলিয়ে বলতে হয়-
বাংলা আমার জীবনানন্দ,
বাংলা প্রাণের সুখ,
আমি একবার দেখি, বার বার দেখি,
দেখি বাংলার মুখ ।
কিন্তু এ রূপসী বাংলার স্নেহ মায়া ত্যাগ করে দেশের মেধাবী ছেলেরা বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। এ হরিলুটের দেশে মেধাবী ছেলেরা তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছে। রাজনৈতিক নেতাদের দেয়া আশ্বাসকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। এরা কেউ কথা দিয়ে কথা রাখে না। ক্ষমতার লোভে এবং নিজের সুখের জন্য দেশ বিক্রি করতে কুণ্ঠাবোধ করেনা। বিশ্বজিৎ হত্যা, বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যার ভিডিও ক্লিপ দেখলে চোখের পানি ধরে রাখা যায়না। তনু ও ত্বকী হত্যার বিচার আজও ঝুলে আছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির নির্মম হত্যাকান্ডের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার তারিখ ১২১ বার পরিবর্তন হয়েছে। ২০১২ সালে ১১ ফেব্রæয়ারি এ দম্পতিকে হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডের দীর্ঘ ১৩ বছর পরও বিচার কার্যক্রম আজ পর্যন্ত শুরু করা যায়নি। এ প্রশ্ন কার কাছে রাখি? আমরা কোন দেশে বাস করি? অথচ দেশের জাতীয় সংগীতটি একবারও কি শুনার প্রয়োজন মনে করি ? তাই তো বলি,
মা তোর বদন খানি মলিন হলে-
আমি নয়ন জলে ভাসি,
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি।
ইতি
আপনারই ভাগিনা।