আমার কাগজ ডেস্ক
মাথায় দেনার বোঝা। সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরতে হয় ‘লুকিয়ে’। বাড়িতে বউ ও একমাত্র শিশুসন্তান। আছেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবা, ছোট ভাই-বোনও। ব্যাংকের ক্যাশিয়ারের চাকরিতে দিন চলে না। ভাস্কর তবু জীবন উপভোগ করতে চায়। মুখে তার হাসি লেগেই থাকে। সন্তান তার বন্ধুর জন্মদিনে যাবে, উপহার দেবে কী? অনেক কষ্টে সন্তানের জন্য কেনা উপহার নিয়েই শেষমেশ মা রওনা দেন। বাড়িতে ঠিকঠাক খাবার মেলে না। শিশুটি তাই বন্ধুদের জন্মদিনের উদ্যাপনে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকে। কেক তো পেট ভরে খাওয়া যাবে। এটা নিয়েও শুনতে হয় বন্ধুদের বিদ্রূপ।
দিনের পর দিন একই জামা পরে যায় সন্তান, মা–বাবা বুকে পাথর চেপে সয়ে যায়। একান্নবর্তী পরিবারের দৈনন্দিন এই ঘষা খাওয়া জীবনের গল্প নিয়েই নির্মিত হয়েছে তেলেগু সিনেমা ‘লাকি ভাস্কর’। গত ৩১ অক্টোবর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পর ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে ভেঙ্কি আতলুরির পিরিয়ড ক্রাইম ড্রামা সিনেমাটি। গত সপ্তাহে নেটফ্লিক্সে আসার পর বাংলাদেশের অনেক দর্শকও মজেছেন এই সিনেমায়। চেনা গল্প, দুর্দান্ত অভিনয়, টান টান চিত্রনাট্য মিলিয়ে ‘লাকি ভাস্কর’ নিয়ে অন্তর্জালে সরব অনেক দেশি দর্শক।
‘লাকি ভাস্কর’কে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে আছে ভাস্করের জীবনসংগ্রাম। কিন্তু মাঝপথে ভাস্কর পেয়ে যায় ওপরে ওঠার রাস্তা। সেটা বৈধ কিছু নয়। তবু চরম বাস্তবতায় সে ওই পথ বেছে নেয় সংকোচ ছাড়াই। শুরু হয় ইঁদুর-দৌড় খেলা।
পরতে পরতে চরম রোমাঞ্চ ছড়ানো ছবিটি এতটা আলোচিত হয়েছে এর বাণিজ্যিক উপাদানের কারণেই। তবে প্রচলিত বাণিজ্যিক সিনেমা নয়, নির্মাতা বরং উপহার দিয়েছেন খুবই বুদ্ধিদীপ্ত এক গল্প। তাঁর দারুণ চিত্রনাট্য, দুর্দান্ত নির্মাণের গুণেই কিছু খামতি থাকলেও ভালোভাবেই উতরে গেছে ‘লাকি ভাস্কর’।
আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে হালে বেশ কয়েকটি হিন্দি সিনেমা ও সিরিজ হয়েছে। তারপরও ‘লাকি ভাস্কর’ নির্মাণগুণে আলাদা জায়গা নিয়ে থাকবে। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, যে কিনা ব্যাংকের ক্যাশিয়ার থেকে শতকোটির মালিক হয়, খুব চেনা এই গল্পেও নতুন অনেক কিছুই উপহার দিয়েছেন নির্মাতা।
আশির দশকের মুম্বাই থেকে শুরু হয়ে গল্পটি শেষ হয়েছে নব্বইয়ের দশকে। ভারতের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে হার্শাদ মেহতার নাম কে না জানে! ভাস্করের গল্প হলেও তিনি এ ছবিতে আছেন প্রবলভাবেই। হার্শাদের মতো উচ্চাশা নিয়ে অনেক মধ্যবিত্তও বড় দাও মারার সুযোগ পেয়েছিলেন। বাস্তব ঘটনা আর কল্পনার আশ্রয় নিয়ে সেই স্বপ্নের জগৎই তৈরি করেছেন নির্মাতা। বিনোদনের মোড়কে আর্থিক দুর্নীতি তিনি সাধারণ দর্শকের উপযোগী করে যেভাবে তুলে ধরেছেন, সেটা দুর্দান্ত।
আতলুরির চিত্রনাট্য ও নির্মাণ দুটোই টানটান। রোমাঞ্চ আর দুর্দান্ত গতির কারণেই পর্দা থেকে চোখ সরানো যায় না। মনে হয়, এই বুঝি ভাস্কর ধরা পড়ে যাবে; কিন্তু সে ঠিকই চ্যালেঞ্জ উতরে যায়। পরে হাজির হয় আরও বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছবির ভিজ্যুয়াল দুর্দান্ত। আতলুরি যেভাবে সেই সময়ের মুম্বাই ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন, সেটাও খুবই বিশ্বাসযোগ্য।
তবে সিনেমাটি এতটা প্রশংসিত হওয়ার আরও একটি বড় কারণ দুলকার সালমান। জনপ্রিয় এই মালয়ালম তারকার গত বছর সেভাবে আলোচিত সিনেমা ছিল না। ‘লাকি ভাস্কর’ দিয়ে ফেরার মতোই ফিরলেন তিনি। মধ্যবিত্ত ব্যাংকার থেকে শতকোটির মালিক ভাস্কর—এমন চরিত্র পর্দায় তিনি তুলে ধরেছেন খুবই বিশ্বাসযোগ্যভাবে। তাঁর প্রতিটি সংলাপ বলা, অঙ্গভঙ্গি থেকে রোমাঞ্চকর যাত্রা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা গেছে। তাঁর স্ত্রীর মীনাক্ষী চৌধুরীও দারুণ। এই সিনেমা দিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন যে গ্ল্যামারাস চরিত্রের বাইরে সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহবধূর চরিত্রেও তিনি ভালো করতে পারেন। ‘লাকি ভাস্কর’-এ প্রতিটি চরিত্রের কিছু না কিছু ভূমিকা আছে। এমনকি ভাস্করের বাবা, যে পুরো ছবিতেই পক্ষাঘাতের কারণে নির্বাক, সে–ও শেষের দিকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
নির্মাতা ভেঙ্কি আতলুরির শুরুটা ছিল দারুণ। বরুণ তেজ ও রাশি খান্নাকে নিয়ে ‘থোলি প্রেমা’র মতো হিট ছবি উপহার দিয়েছিলেন তিনি। এরপরই খেই হারান। গত বছর আবার ধানুশের সঙ্গে ‘ভাথি’ দিয়ে বলা যায় নতুন যাত্রা শুরু করেন।
‘ বিনোদনের উপাদানে মোড়া সিনেমা যা একই সঙ্গে সাধারণ দর্শক ও সমালোচকদের তুষ্ট করবে, এমন ছবি করা কঠিন। কিন্তু সেই কঠিন কাজই দারুণ বুদ্ধিদীপ্তভাবে করেছেন আতলুরি।
সিনেমার শেষটাও দারুণ, বলা যায় দর্শকের প্রত্যাশা সব দিক থেকেই পূরণ করেছেন নির্মাতা। ভাস্করের মতো জীবন আমাদের অনেকেরই, সবাই হয়তো চান ভাস্কর থেকে ‘লাকি ভাস্কর’ হতে। কেউ কেউ পারেন, বেশির ভাগই পারেন না। ভাস্কর যে পেরেছে, পর্দায় হলেও সেটা দেখা খারাপ কী!