
আমার কাগজ প্রতিনিধি
বিপ্লব শিকদার এখন এলাকায় ‘বেগুন বিপ্লব’ নামেই অধিক পরিচিত। পঞ্চাশোর্ধ্ব বিপ্লবের নামের সঙ্গে ‘বেগুন’ যুক্ত হলো কেন? পাশে তাঁর স্ত্রী সংগীতা রাণী এই প্রশ্ন শুনে হাসলেন। বিপ্লব বিব্রত না হয়ে বরং চওড়া হাসি দিয়ে গর্বের সঙ্গেই বললেন, ‘বেগুন চাষ করে আমার সমৃদ্ধি এসেছে বলেই লোকজন আমাকে এই নামে ডাকেন।’
বঙ্গোপসাগর–তীরের বরগুনার তালতলী উপজেলার পাজরাভাঙ্গা জনপদে বিপ্লবের এই সুখ্যাতির গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামে ঢুকতেই তা টের পাওয়া গেল। শহিদুল ইসলাম নামের এক যুবকের কাছে বিপ্লবের বাড়ি কোনটা জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘বেগুন বিপ্লব? ওই তো, সামনেই!’
একটু সামনে এগোতেই চোখে পড়ল সাজানো গোছানো এক সবুজ খেত। সারি সারি সবুজ বেগুনগাছ আর তাতে ঝুলছে বড় বড় বেগুন। চোখজুড়ানো এই মনোহর দৃশ্য যে কাউকে সতেজ করে। কাছে গিয়ে দেখা গেল, বিপ্লব ও সংগীতা দম্পতি পরম যত্নে গাছগুলোর পরিচর্যা করছেন। গাছ থেকে বেগুন কেটে ঝুড়িতে রাখছেন।
রোদের উত্তাপ থেকে একটু ছায়ার আশ্রয়ে এসে কথা তুলতেই বিপ্লবের মুখ ম্লান হলো। বললেন, ‘জীবনে অনেক কষ্ট করছি, এরপর এখন সাফল্য।’ সেই কষ্ট কেমন? প্রশ্ন শুনেই কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বিপ্লব বলে চললেন সেই কষ্টগাথা।
বিপ্লব শিকদারের বাবা নির্মল চন্দ্র শিকদার খেয়েপরে পরিবার নিয়ে ভালোই ছিলেন। এক ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে চারজনের সংসার চলছিল কৃষির ওপর। প্রায় ছয় একর জমি ছিল। কিন্তু বিপত্তি হয়, জমিজমা নিয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে একসময় মামলায় জড়ানোর পর। প্রায় চার একর জমি বিক্রি করে মামলা চালাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হন। বিপ্লব তখন মাধ্যমিকের ছাত্র। বৃদ্ধ বাবার পরিবারে নেমে আসে ঘোরতর দুর্দিন। বিপ্লবের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। সংসারের হাল ধরতে তাঁকে আয়ের পথ খুঁজতে হয়। দারিদ্র্যের সঙ্গে অনবরত যুদ্ধ করতে করতে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন বিপ্লব। সামান্য কিছু পুঁজি নিয়ে তালতলী সদরে শুরু করেছিলেন সবজির ব্যবসা। পরে খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়া থেকে সবজি এনে পাইকারি ব্যবসা করেছিলেন কিছুদিন। কিন্তু বাজারের ওঠানামায় সেই ব্যবসা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি আরও হতাশ হন। দারিদ্র্য যেন নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এরপর বিয়ে করে সংসার হয়। সবকিছু সামলাতে গিয়ে হতাশায় নুয়ে পড়ে জীবন।
বিপ্লব শিকদার বলেন, এই যখন অবস্থা, তখন একদিন তাঁর কানে এল এক বিশেষ জাতের বেগুনের গল্প। রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষদের চাষ করা এই বিশেষ জাতের বেগুন নাকি আকারে বড়, স্বাদে অনন্য, আর চাহিদাও ব্যাপক! এই গল্প শুনে কৌতূহল জাগল বিপ্লবের। তিনি খোঁজ নিতে শুরু করলেন এবং জানতে পারলেন, ঠিকঠাক যত্ন নিলে এই বেগুন হতে পারে তাঁর ভাগ্যবদলের চাবিকাঠি। ব্যস, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন—এই রাখাইন বেগুন আবাদ করে টিকে থাকার শেষ চেষ্টাটা করবেন।
সেটা ২০১১ সালের কথা। রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছ থেকে চারা সংগ্রহ করে প্রথমে বাড়ির ২০ কাঠা জমিতে এই বেগুন চাষ শুরু করেন। প্রথম বছরেই আশাতীত সাফল্য পান। প্রায় ৩০ হাজার টাকা লাভ হয়। ফলন যেমন ভালো, চাহিদাও তেমনি বেশি। সেই যে শুরু আর পেছনে ফিরে তাকাননি বিপ্লব। ক্রমে জমির পরিমাণ বাড়াতে থাকেন। এখন তিনি পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ২ একর জমিতে বেগুন চাষ করছেন। এতে প্রতি মৌসুমে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা লাভ করছেন। বিপ্লবের সঙ্গে খেতের পরিচর্যা থেকে শুরু করে বেগুন তোলা, বিক্রি সবকিছুতেই সার্বক্ষণিক সহায়তা করছেন স্ত্রী সংগীতা রাণী।
সংগীতা রাণী বলেন, ‘প্রতিবছর এই বেগুন বিক্রি করে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা আয় হয় আমাদের। বাজারে এর চাহিদা অনেক বেশি। বেগুন আবাদ করে আমাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছে। দুই ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছি, এখন আমরা সব দিক থেকেই স্বাবলম্বী।’
বিপ্লব বলেন, অগ্রহায়ণ মাসের শুরু থেকে ১৫ ফাল্গুন পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ১০০ কেজি বেগুন আসে খেত থেকে। স্থানীয় বাজারে তা ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি করেন। বিপ্লবের এই সাফল্য শুধু তাঁর নিজের জীবন বদলে দেয়নি; বরং আশপাশের কৃষকদেরও অনুপ্রাণিত করছে এই বেগুন চাষে এগিয়ে আসতে।
রাখাইন বেগুনের ইতিহাস
স্থানীয় লোকজনের মতে, তালতলী উপজেলার আগাঠাকুরপাড়া এলাকার বাসিন্দা অংসিত মং রাখাইন আশির দশকের মাঝামাঝি মিয়ানমার থেকে এই বেগুনের বীজ এনে বাড়িতে চাষ করেছিলেন। বেগুনের আকার দেখে সবাই অভিভূত হন। একই সঙ্গে এর স্বাদও ভিন্নতর এবং অতুলনীয়। পরে তাঁর কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করে তালতলীর বিভিন্ন রাখাইন পল্লির বাসিন্দারা এই বেগুনের চাষ শুরু করেন। কয়েক বছরের মধ্যে তা তালতলী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তালতলী, বরগুনা, পটুয়াখালীর কলাপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় এই বেগুনের চাষ ও চাহিদা বাড়তে থাকে।
বিপ্লব শিকদারের খেত থেকে বেগুন কিনে বাজারে নেওয়ার জন্য স্তূপ করে রেখেছেন পাইকার। সম্প্রতি বরগুনার তালতলী উপজেলার পাজরাভাঙ্গা এলাকায়
বিপ্লব শিকদারের খেত থেকে বেগুন কিনে বাজারে নেওয়ার জন্য স্তূপ করে রেখেছেন পাইকার। সম্প্রতি বরগুনার তালতলী উপজেলার পাজরাভাঙ্গা এলাকায়ছবি:
রাখাইন সম্প্রদায়ের কয়েকজন চাষি জানান, এই বেগুনের চারা রোপণের দুই মাস পর ফলন আসতে শুরু করে এবং পাঁচ মাস ধরে উৎপাদন অব্যাহত থাকে। শুরু থেকেই এই বেগুন ‘রাখাইন বেগুন’ নামে পরিচিতি পায়। কেউ কেউ এই বেগুনকে কেজি বেগুন নামেও চেনে।
অংসিত মং রাখাইনের ছেলে সুথেন রাখাইন বলেন, ‘আমার বাবা প্রায় ৪০ বছরের বেশি সময় আগে তালতলীতে এই বেগুনের চাষ করেছিলেন। শুরুতে এটাকে মানুষ কেজি বেগুন বলত। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে যখন এই বেগুন আশপাশের গ্রামে চাষ শুরু করে তখন এটা রাখাইন বেগুন নামে পরিচিতি পায়। এখন যে বেগুনটিকে বারি-১২ নামে পরিচিত করা হচ্ছে, সেটিই আসলে আমাদের রাখাইন বেগুন।’
বারি বেগুন-১২: নতুন পরিচয়
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এই জাতটি পরিশুদ্ধ করে উদ্ভাবন করায় জাতটি এখন ‘বারি বেগুন-১২’ নামে পরিচিত। উচ্চফলনশীল ও অধিক রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতাসম্পন্ন এই বেগুন লবণাক্ত জমিতেও চাষাবাদ করা যায়। এ ছাড়া এই জাতের একেকটি বেগুনের সর্বোচ্চ ওজন হয় দেড় কেজি পর্যন্ত। ২০২২ সালের ২৬ জুন নতুন উদ্ভাবিত বারি বেগুন-১২ নামে এ জাতটির সনদ দেয় বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অনুবিভাগ।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, ২০১২ সালে পটুয়াখালী আঞ্চলিক উদ্যান তত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকেরা এই বীজ সংগ্রহ করে গবেষণা শুরু করেন। ওই কেন্দ্রের তৎকালীন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান এবং অন্যরা মিলে দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর গবেষণা করে সফল হন। এ সময়ে তাঁরা জাতটি দক্ষিণাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল এমনকি পাহাড়ি এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে চাষের উদ্যোগ নেন এবং সফলতা পান। মোস্তাফিজুর রহমান তালুকদার বর্তমানে বরিশাল আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই বেগুনের সম্পূর্ণ একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছি। এটি লবণাক্ত জমিতেও চাষাবাদ করা যায়। বর্তমানে জাতটি সারা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।’
তালতলীর সেই রাখাইন বেগুন বারি-১২ জাত হিসেবে এখন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। জাতটি আবাদ করে বেশ লাভবান হচ্ছেন কৃষকেরা। বরগুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় প্রায় ২০ একর জমিতে উচ্চফলনশীল এই বেগুনের চাষ হচ্ছে, যার অধিকাংশ তালতলী উপজেলায়।
বরগুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সৈয়দ জোবায়দুর আমল বলেন, ‘এই বেগুন প্রথমে তালতলীতে রাখাইন সম্প্রদায়ের একজন সদস্য আনেন। এরপর এটি ছড়িয়ে পড়ে এবং বর্তমানে দেশজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কৃষিতে এই বেগুনের জাতটি নতুন এক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।’