হাওর অঞ্চল প্রতিনিধি
কিশোরগঞ্জের নিকলীও তার তৎসংলগ্ন হাওর অঞ্চলসহ প্রায় সকল গ্রাম-গঞ্জে শহর-নগরে অনিয়মের সুযোগে চলে বাল্য বিবাহ ও ত্রুটিপূর্ণ বহু বিবাহ।
বাল্য বিবাহ ও ত্রুটিপূর্ণ বিবাহের প্রধান দায়ী অবৈধ নিকাহ নিবন্ধনে সহায়তাকারী আইনজীবীদের ঘোষণাপত্রের নোটারি পাবলিক। বর্তমানে অনেক বিবাহ ও তালাক রেজিষ্ট্রি হচ্ছে এসবের সহায়তায়। নিয়ম-বহির্ভূতভাবে অসাধু আইনজীবীদের ত্রুটিপূর্ণ নোটারির কারণে অভয় থেকেই বেড়ে চলেছে বাল্য বিবাহ বা বহু বিবাহ । বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে তুলনামূলক বেশি। আদালত চত্বরেসহ প্রকাশ্যে বিভিন্ন স্থানে বিবাহ ও তালাক রেজিষ্ট্রির অসংখ্য ঘোষণার দলিল প্রশ্নবিদ্ধ হলেও থেমে নেই এর কার্যক্রম।
নোটারি পাবলিককে সংক্ষেপে নোটারি বলা হয়ে থাকে। নোটারি শব্দের মূল নামপদ ‘note’ এবং ‘ary’ অনুসর্গে গঠিত লাতিন ভাষার nota+arius থেকে এসেছে। যা শর্টহ্যান্ড লেখক বা কেরানি ইত্যাদি অর্থেও ব্যবহৃত হয়। নোটারি বিধিমালা ৬০(ক) ধারা অনুযায়ী যিনি নোটারি করে দেন তাঁর একটি নির্দিষ্ট কার্যালয় থাকতে হয়। এছাড়াও সাধারণত কমপক্ষে ৭বছর আইনজীবি পেশায় বা বিচার বিভাগের সদস্য হিসেবে ৫ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা কিংবা সরকারের লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং এবং সরকারের আইন প্রণয়নকাজে নিয়োজিত ছিলেন এমন ব্যক্তিরাই নোটারি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। ওরা মূল কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ে নিশ্চিত হলে তাতে সত্যায়ন করেন। এটা অফিসিয়ালি গ্রহনযোগ্য হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। তবে বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে বয়সের এফিডেভিট গ্রহনযোগ্যতা হারালেও থেমে নেই অবৈধ উপায়ে অসাধুদের নোটারি কাজ।
আইনগত বৈধতা না থাকলেও প্রশাসনের সামনে আদালত চত্বরেই নোটারি পাবলিকের নামে হচ্ছে নিকাহ নিবন্ধনের ঘোষণাপত্র তৈরির সূত্রপাত।
অনেকে আবার নিজেস্ব চেম্বারে বা বাসায় বসেও তৈরি করে দিচ্ছেন বিয়ে নিবন্ধন তৈরির সহায়ক ঘোষণাপত্র। সুযোগে ভুল ধারণার কারণে আইনি সহায়ক ভেবে সাধারণের মাঝে ভয়ও কমে গেছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে অধিক। মুসলিম বিবাহে গ্রাম্য মুন্সি, মৌলভী বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের যারা সামাজিক বৈবাহিক বন্ধন বা দাম্পত্য জীবন গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালনে জড়িত এদের অনেকেই এই ঘোষণা পত্রের আইনি যাচাই-বাছাই ছাড়াই ছাড়া বিবাহ তৈরীতে সহায়তা করে থাকেন।ষ বলে অভিযোগ উঠেছে।
অপরদিকে ইউনিয়ন ভিত্তিক সরকারীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত অনেক কাজীও অর্থনৈতিক সুবিধার মোহে পড়ে ভিন্ন কৌশলে বাল্য বিবাহ বা ত্রুটিপূর্ণ বিবাহের কাজে জড়িত থাকে বলে অভিযোগ মিলে। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে অসাধু কাজীরা বিয়ে রেজিস্ট্রির মূল ভলিয়মে না উঠিয়ে ফর্মে স্বাক্ষর বা টিপসই রেখে রেজিস্ট্রেশনের কথা বলে শান্তনা দিয়ে বিদায় দেন। তবে বিপদ এড়াতে প্রাপ্ত বয়স্ক হলে এসব অসাধু কাজীরা মূল ভলিয়মে উঠিয়ে থাকেন। এভাবে অসাধু কাজীরা অর্থনৈতিক ফায়দা লুটে থাকেন বলে সাধারণের কাছ থেকে এমন অভিযোগ উঠেছে। সচেতন মহলের ভাষ্য এর ফলে বাড়ছে বাল্য বিবাহ, বাড়ছে দাম্পত্য জীবনে কলহ বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে ১৯৯৮ সালের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক, ইউনিসেফ বাংলাদেশ-এর সহায়তায় প্রকাশিত পারিবারিক আইনে দেশটির নারী আইন ও সালিশ কেন্দ্র প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালের জুন মাসে। মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন হয় ১৯৭৪ সনে। সরকার ২০১২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন করে। ১৮৭২ সালের খ্রিস্টান ম্যারেজ এ্যাক্ট অনুযায়ী খ্রিস্টানদের বিয়েও এ দেশে রেজিস্ট্রেশন হয়।
এই বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে মন্ত্রনালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি হলেও অদ্যাবধি থেমে নেই অনিয়মের ত্রুটিপূর্ণ বহু বিবাহ বা বাল্য বিবাহ।
আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো.নরুল আলম সিদ্দিকি স্বাক্ষরিত ২৯ এপ্রিল স্মারক নং- আর-৬/৭ এন- ৮/২০১৫-১৭৫ স্মারকে জারীকৃত এক নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে নোটারি পাবলিক এফিডেফিট মাধ্যমে বিয়ে পড়াতে বা নিবন্ধন করাতে পারবেন না বলেও। জনগণকে ব্যাপকভাবে অবহিতকরণের ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে অত্র বিভাগকে নির্দেশনা দেয়া হয়। মুসলিম আইন অনুযায়ী বিবাহের আবশ্যকীয় উপাদান হচ্ছে (ক) বর বা কনে এদের কোন এক পক্ষ কর্তৃক বিবাহের প্রস্তাব প্রদান, (খ) অন্য পক্ষ কর্তৃক উক্ত প্রস্তাব গ্রহন (গ) কমপক্ষে ০২ (দুই) জন সাক্ষী এবং (ঘ) দেনমোহর টাকা। এসবের কোন একটি অনুপস্থিত থাকালে বিবহ আইন সিদ্ধ হবে না।
এ মর্মে ১৯ নভেম্বর ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের গভর্নেন্স ইউনিট কর্তৃক বাল্য বিবাহ নিরোধে কাজীদের ভূমিকা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রসঙ্গও উল্লেখ করা হয়।
এ সত্বেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, নোটারী পাবলিক কর্তৃক পাত্র/পাত্রী কেবলমাত্র একটি ঘোষনা সম্বলিত এফিডেভিটের মাধ্যমে তথা কথিত বিয়ে পড়ানো হচ্ছে, যা আইনে মোটেও স্বীকৃত নয়। এতে একদিকে যেমন বিবাহের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তেমনি অন্যদিকে বিবাহ বা তালাক রেজিস্ট্রী না হওয়ায় উহার কোন আইনয়ত দালিলিক সুরক্ষা ও এ থাকে না। তাছাড়া নোটারী পাবলিকের নিকট এরূপ ঘোষণার আইনগত কোন ভিত্তিও নাই বিধায় নোটারী পাবলিক কর্তৃক এফিডেভিটের মাধ্যমে বিবাহ পড়ানো ও তালাক রেজিস্ট্রারী বন্ধ হওয়া আবশ্যকীয় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
তৎসত্ত্বেও বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনে কার্যকর না থাকায় পুনরায় নং-আর-৬/৭ এন-৮/২০১৫-১৬৫ স্মারকে ২১ মার্চ ২০১৭ সালে বাল্য বিবাহ বন্ধের লক্ষ্যে নোটারি কর্তৃক বয়স এফিডেভিট ব্যবহার বন্ধেরও নির্দেশ দেয়া হয়। এ সময়ে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে এ দেশের নারীদের নিরাপদ কৈশোর নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে একাধিক সময়ে এ উদ্যোগের কথাও উল্লেখ করা হয়। এমনকি ১৯২৯ সালের বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন কার্যকর রয়েছে বলেও জানান। এই মর্মে সকল জেলা প্রশাসক, জেলা জজ ও আইনজীবী সমিতির সভাপতিকে লক্ষ্য করে পুনরায় চিঠি ইস্যু হয় সিনিয়র সহকারী সচিব আনোয়ারুল হক কর্তৃক।
জারইতলা ইউনিয়ন ভিত্তিক নিকাহ রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ ইদ্রিছ আলীর বিরুদ্ধে একাধিক সময়ে নিকাহ নিবন্ধনের অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে বলে অত্র ইউনিয়নের রোদার পুড্ডা গ্রামের মোহাম্মদ মামুন সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ তুলেন। তবে আইন মন্ত্রণালয় হতে কাজী ইদ্রিস আলীর পক্ষে সব কটি রায় এসেছে বলেও দাবি তুলেন।
শুধু জারইতলার কাজী ইদ্রিস আলীর ঘটনা নয় বরং অসংখ্য নিকাহ নিবন্ধন তৈরির কাজে জড়িত অসাধু কাজীদের বিরুদ্ধেও মামলা মোকাদ্দমা ও অনিয়মের অভিযোগের বাস্তবতা মিলে।
কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য কুলেশ চন্দ্র নাগ কাজল এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আদালতের চেম্বারে বা নিজেস্ব অফিস থেকে তারা শুধু ঘোষণার লক্ষ্যে আবেদন করে থাকেন। বিয়ের ক্ষেত্রে এটা রেজিস্ট্রেশনের দায়িত্ব থাকারা আমলে নিতেও পারেন আবার নাও নিতে পারেন।
কিশোরগঞ্জ জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) জালাল উদ্দিন বলেন, বিয়ে রেজিস্ট্রির ক্ষেত্রে নোটারি পাবলিকের বিষয়টি অত্যন্ত দুর্বল। এ ক্ষেত্রে গ্রহণ যোগ্যতা তেমন একটা নেই বলেও স্বীকার করেন। আদালতে ৬০০ জনের অধিক আইনজীবীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিভিন্ন ধরণের আইনি সহায়তার লক্ষ্যে নোটারি কার্যক্রম করে থাকেন বলে জানান। তবে বিয়ে রেজিস্ট্রির জন্যে আলাদা সেক্টর রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
নিকলী জারইতলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বেলায়েত হোসেন বাদল বলেন, অজ্ঞতার অভাবে আর অসাধুদের কারণে বাল্য বিবাহের সুযোগ পায় কিশোর কিশোরীরা। অসংখ্য শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও এসব অনিয়মের তথ্য মিলে বলে তিনি নিশ্চিত করে।
নিকলী উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা পাপিয়া আক্তারের কাছে নোটারি পাবলিকের বিষয়ে কথা হলে এই বিষয়ে তিনি সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে বিয়ে রেজিস্ট্রির কোনো ধরণের সুযোগ নেই।
কিশোরগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল মামুনের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাওয়ার জবাবে বলেন, বাল্য বিবাহ তৈরিতে সাহায্যকারী নোটারি পাবলিক আইনিভাবে নিসিদ্ধ। তবে নিয়মের মধ্যে থেকে কিছু কিছু নোটারি কার্যক্রম চালুর করা স্বীকার করেন।
সাবেক জেলা জজ ড. মোহাম্মদ আমির উদ্দিন নোটারি সম্পর্কে বলেন, ‘বয়স বাড়িয়ে বিভিন্ন ধরণের ডকুমেন্টের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঘোষণাপত্র তৈরি সম্পূর্ণরূপে আইনয়ত অবৈধ’ কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানের কাছে নোটারি বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরে কি ধরণের নিয়মের ভেতরে নোটারি করে থাকেন সুনির্দিষ্টভাবে অধীনস্থদের কাছে এ তথ্য জেনে নেওয়ারও পরামর্শ প্রদান করেন।