মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রিন্স
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারিদের সকল প্রাপ্তির পেছনে রয়েছে আন্দোলনের এক বিরাট ইতিহাস। সময়ের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বর্তমানে বেসিক শিক্ষক-কর্মচারিবৃন্দ একটা অবস্থানে থাকলেও তা সময়ের প্রয়োজনে অপ্রতুল। মান-মর্যাদার দিক থেকেও বেসিক শিক্ষকরা নিগৃহীত। দেশজ মোট শিক্ষার ৯৭% দায়িত্বশীল এসব শিক্ষক সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় বিরাট বৈষম্যের শিকার। শিক্ষার সুষম উন্নয়নে এ বৈষম্য দূর করা এখন সময়ের দাবি। ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক তৈরির জন্য সরকারের যে পরিকল্পনা তা বাস্তবায়নের জন্য প্রধান কারিগর হচ্ছেন শিক্ষক। শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নে সর্বোচ্চ বিনিয়োগের বিকল্প নেই।
মানসম্মত শিক্ষার জন্য যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করা এবং মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে মাধ্যমিক স্তরে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন এবং শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ ধরে শিক্ষা ব্যবস্থা বিশেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের কোন বিকল্প নেই।
মানসম্মত শিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল পেতে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বরাদ্দ সহ প্রাথমিক পর্যায়ে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ খুবই জরুরি। শিক্ষা জাতীয়করণ এর অর্থ- শিক্ষার যাবতীয় দায়ভার সরকারের।
দেশের সাতানব্বই শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী দ্বারা। পরিতাপের বিষয় এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ মাত্র ১, ০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া, ২৫% উৎসব ভাতা এবং ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পায়। অথচ একই কারিকুলামের অধীন একই সিলেবাস, একই একাডেমিক সময়সূচি, একইভাবে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়নের কাজে নিয়োজিত থেকেও আর্থিক সুবিধার ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছে পাহাড়সম বৈষম্য। এছাড়াও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বেতন স্কেল সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বেতন স্কেলের একধাপ নিচে প্রদান করা হয়। তাছাড়া সহকারি প্রধান শিক্ষকদের উচ্চতর স্কেল প্রদান না করার ফলে উচ্চতর স্কেলপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষকদের বেতন স্কেল আর সহকারি প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল সমান হওয়ায় সহকারি প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে দীর্ঘদিনের অসন্তোষ বিরাজমান।
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসরে যাবার পর অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। ফলে অনেক শিক্ষক/কর্মচারী টাকা পাওয়ার পূর্বেই অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করছেন। তাছাড়া কয়েক বছর যাবৎ মহামান্য হাইকোর্টের রুল থাকা সত্বেও শিক্ষকদের অতিরিক্ত কর্তনকৃত ৪% এর বিপরীতে কোন প্রকার সুযোগ-সুবিধা না দিয়েই অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্ট খাতে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে ৬% এর পরিবর্তে অতিরিক্ত ৪% বৃদ্ধি করে ১০% কর্তন করা হচ্ছে যা অত্যন্ত অমানবিক ও নীতিবহিভর্‚ত। তাই অতিরিক্ত ৪% কর্তনের প্রতিবাদে শিক্ষক সংগঠন সমুহ মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলসহ অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট অফিস ঘেরার মাধ্যমে প্রতিবাদ করেও কোন প্রতিকার পাননি।
শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়ন(বশিইউ) সহ সমমনা শিক্ষক সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে। বেসরকারি শিক্ষক সমাজের যতটুকু উন্নতি হয়েছে আন্দোলনের মাধ্যমেই হয়েছে। আন্দোলনের ফলে আর্থিক ও সামাজিক উন্নতি হয়েছে তবুও রয়ে গেছে বৈষম্য।
গণতান্ত্রিক, অসাপ্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক ও উপযোগিতামূলক শিক্ষানীতি প্রবর্তনসহ শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের জন্য। বাংলাদেশের প্রায় সব শিক্ষক সংগঠনই দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্নভাবে সরকারের নিকট দাবিনামা উপস্থাপনসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন। পাশাপাশি উপজেলা থেকে শুরু করে জেলা ও বিভাগীয় শহরে সমাবেশ, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, প্রতীকি অনশন, অবস্থান ধর্মঘট ও কর্মবিরতি পালনসহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এবং জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মহাসমাবেশসহ নানা কর্মসূচী পালন করেছে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটকে সামনে রেখে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন “মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ” এর ন্যায়সঙ্গত দাবিতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল এবং জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশসহ বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য বাজেটে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের ঘোষণাসহ পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখার জোর দাবি জানান। অন্যথায় ১১ জুন ২০২৩ থেকে অবিরাম ধর্মঘট পালনসহ কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে এসব শিক্ষক সংগঠন থেকে জানানো হয়েছিল।
এহেন পরিস্থিতিতে, গত ২৬ জুন ২০২৩ -২০২৪ অর্থ বছরের বাজেট পাস হয়েছে। বাজেট পাস পর্যন্ত শিক্ষক সমাজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল জাতীয়করণের জন্য বরাদ্দ এবং সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আসবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এ বাজেটে সেটা হয়নি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে একটি যুদ্ধবিধস্ত দেশে প্রায় ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে বঙ্গবন্ধু তনয়া শিক্ষা ও শিক্ষক বান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ২৬ হাজার বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে জাতির কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন।
এমতাবস্থায় দেশ ও জনগণের স্বার্থে দ্রুত জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়ন, শিক্ষায় বিনিয়োগে ইউনেস্কো-আইএলও’র সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নসহ সবার জন্য শিক্ষা গ্রহণের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করার জন্য শিক্ষক সংগঠনগুলো দাবি জানিয়ে আসছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)’র অনুমোদিত ১৪৬টি সুপারিশ সম্বলিত শিক্ষকদের মর্যাদা বিষয়ক সনদের সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ অথবা জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের কথা উল্লেখ থাকলেও ২০২২-২৩ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১১.৯২ শতাংশ অথবা জিডিপি’র ১.৮৩ শতাংশ। অথচ ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বরাদ্দ কমিয়ে জাতীয় বাজেটের ১১.৫৭ শতাংশ অথবা জিডিপির ১.৭৬ শতাংশ করা হয়েছে। তাই ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সারাজাতি আজ চরম হতাশায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। স্বপ্নের পদ্মা সেতু তৈরি, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ, রূপপুর পারমানবিক বিদুৎ কেন্দ্র ও মাতার বাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে কোটি কোটি বই বিতরণ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন, মেট্রোরেল নির্মাণ, কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেভাবে উন্নয়ন হয়েছে, শিক্ষা ও শিক্ষকদের উন্নয়ন সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। বর্তমান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা বিবৃতিতে বলছেন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা স্মার্ট করতে হলে দরকার স্মার্ট শিক্ষক। তাই স্মার্ট শিক্ষক পেতে শিক্ষা ও শিক্ষকের পেশাগত মান মর্যাদায় বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ অতীব জরুরী। অপ্রিয় হলেও সত্য নতুন যাঁরা এ পেশায় যোগ দিয়েছেন তাদের অনেকেই বেসরকারি শিক্ষকদের দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাস জানেন না। তাদেরও দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমরা যারা শিক্ষক সংগঠন করি আমরাও বা কতটুকু অতীত নিয়ে জানার চেষ্টা করি। আমাদের চেতনার স্তর পরিবর্তন করা দরকার, তার জন্য পড়াশোনার দরকার। দেশের ইতিহাস, শিক্ষক আন্দোলনের ইতিহাস জানা দরকার। ১৯৭৩ সালের মত দাবি আদায়ে এখন আর শিক্ষকদের প্লাটফর্ম একটি নয় বরং নেতৃত্বে যাওয়ার তীব্র বঞ্চনা থেকে পদবঞ্চিতরা একক সংগঠন বিভাজিত অনেক সংগঠন করেছেন। এতে করে শিক্ষকদের দাবি আদায়ের সংগ্রাম পিছনে পড়ে যাচ্ছে এবং লাভবান হচ্ছে সরকার। প্রতিটি সময়ে আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার জন্য খয়ের খা সংগঠন সৃষ্টি হয়। এরা প্রতিনিয়ত দালালী করে, নিজেদের স্বার্থে কাজ করে। শিক্ষকদের আন্দোলন এভাবেই চলছে। শিক্ষাব্যবস্থার জন্য চিন্তাভাবনা না করা শিক্ষক সংগঠনের দুর্বলতারই দিক। এ সব নানা কারণেই হয়ত শিক্ষক মোর্চা গঠিত হয়নি; আন্দোলনও অতীতের এর মত জোরদার হচ্ছেনা। তবুও শিক্ষক সংগঠনই আমাদের আশ্রয়স্থল, বর্তমানে শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি আদায়ে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বিটিএ), গত কয়েকদিন যাবত জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করার পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে দেয়া সহ নানা কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এ পর্যায়ে প্রতিটি শিক্ষক সংগঠনের উচিত বিটিএ’র শিক্ষা জাতীয়করণের এমন সত্য আন্দোলনে যুগপৎভাবে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং আমাদের শপথ নিতে হবে, আমাদের অঙ্গীকার থাকবে আমরা দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ থাকবো। আমাদের উদ্যম থাকবে উৎসাহ থাকবে- লক্ষ্য একটাই মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ।
আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে অচিরেই ইনশাআল্লাহ।
লেখক : অতিরিক্ত মহাসচিব, বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়ন (বাশিইউ)।
Related Stories
December 19, 2024 8:42 PM
December 19, 2024 8:40 PM