
ধনু নদীর পূর্ব পাড়ের হেমারচর ঘেঁষে বালু তোলার একটি দৃশ্য দেয়া
হাওর অঞ্চল প্রতিনিধি
কিশোরগঞ্জের নিকলীসহ হাওর অঞ্চলের নদীতীর রক্ষায় একদিকে সরকারের শতশত কোটি টাকার কাজ চলে অপরদিকে বেপোরোয়া হয়ে উঠেছে নদীর বুক থেকে বালি উত্তোলনের সাথে জড়িত বালু খেকোরা। বালু খেকোদের দৌরাত্ম্যে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে তীরবর্তী ফসলি জমি ও বিক্ষিপ্ত স্থানের বসতিরা। জনবহুল মূল রাস্তায় পাশে চোখ মেললেই ধরা পড়ে অবৈধ উপায়ে জমা রাখা বালি-মাঠির স্তুপ। সাধারণ জনগণকে ভূল বুঝিয়ে আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে উন্নয়নমূলক কাজের দোহাইয়ে প্রভাবশালী ও স্থানীয় অসাধু নেতাকর্মীরা অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বালু খেকোরা হুমকিতে ফেলেছে নদী সংলগ্ন ভূমি ও বসতভিটে। নদীর বুকেও দিবানিশি মিলছে বালি উত্তোলনের দৃশ্য। সচেতন মহলের ভাষ্য স্থানীয় প্রশাসন ম্যানেজ করেই এসব অপকর্ম করে থাকে বালু খেকোরা।
স্থানীয় নেতাকর্মীদের কোটিপতি বনে যাওয়ার সহজ উপায় নদীর বুকের বালিমাটি উত্তোলন। কথায় বলে নদী নয় যেনো অপরাধীদের টাকার খনি। তদারকির ঘাটতির কারণে নদী সরকারের হলেও বালু যেনো যুগে যুগে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও প্রভাবশালীদের। স্থানীয়দের এমন মন্তব্যের বাস্তবতা ও মিলে সরেজমিনে। এই সহজ উপায়ে অবৈধ পথে কোটিপতি বনে যাওয়াদের বিরুদ্ধে দুদকের সুষ্ঠু নজরদারিরও দাবি তোলেন সুশীল সমাজ ও সচেতন মহল।

নদীমাতৃক এদেশের হাওর অঞ্চলের প্রাণ বলা হয় নদীকে। উত্তর পূর্ব সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ প্রবাহমান একটি নদীর নাম ঘোড়াউত্রা।
সিলেটের উত্তর পূর্ব সিমান্তের বৃহৎ একটি নদী সুরমা। যা উজানের ভারত থেকে নেমে এসেছে বাংলাদেশে। জকিগঞ্জের বরাক মোহনায় এর উৎপত্তি। সেখান থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে দুটি ভাগে একটি সুরমা অপরটি কুশিয়ারা। সুরমা নদীটি সুনামগঞ্জ থেকে সোজা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে নেত্রকোনা জেলার কালিয়াজুড়ি হয়ে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলায় প্রবেশের পর প্রবাহিত হয়েছে ধনু নদী নামে। এটি মিঠামইন ও নিকলীতে এসে ঘোড়াউত্রা নাম ধারণ করে বাজিতপুরের উপর দিয়ে কুলিয়ারচরের কাছাকাছি গিয়ে পতিত হয়েছে ভৈরর সীমান্তবর্তী মেঘনায়। এই নদীর দু’পাশে রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন বসতি ও বিপুল পরিমাণে ফসলি জমি।
দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগের কাছাকাছি সময়ের ব্যবধানে স্থানীয় আ’লীগ নেতাকর্মীদের বেশ কিছু অসাধু নদীর বালিমাঠিকে কেন্দ্র করে দখল বানিজ্যের সুযোগে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন বলে দীর্ঘদিন থেকেই সমালোচনার ঝড় বয়ে চলেছে। সুযোগ নিতে মরিয়া এবার স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীর অনেকে। অসংখ্য স্থানীয়দের দেয়া তথ্য মতে এই নদীর বালি বিক্রিকে কেন্দ্র করে কোটিপতি বনে যাওয়াদের মধ্যে নিকলী সদরসহ ছাতিরচর, সিংপুর, গুরই, কারপাশাসহ বাজিতপুর উপজেলার হিলোচিয়া, দীঘিরপাড়, হুমাইপুর, মাইজচর ও দিলালপুর ইউনিয়নসহ অষ্টগ্রামের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আলীগ সভাপতিদের প্রায় সকলেই কোটিপতি বনে গেছেন বালি উত্তোলনকে কেন্দ্র করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে যুগে যুগে স্থানীয় অসংখ্য অবৈধ বালু খেকোদের দৌরাত্ম্যে অস্তিত্ব হারিয়েছে বিক্ষিপ্ত স্থানের প্রাচীন অসংখ্য বসতি। নিকলীর ছাতিরচরের মরহুম নসু মিয়া, মরহুম মাওলানা নুর উদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, দুদু মিয়া, জঙ্গু মিয়া, মধু মিয়া ও কবি মহিবুর রহিমের মতো অন্ততপক্ষে কয়েকশত পরিবার নদী ভাঙ্গনে বসতভিটা হারিয়ে চিরতরে এলাকা ছাড়া হয়েছেন। নদীর এক দিক দিয়ে যখন বালি উত্তোলনকারীরা ড্রেজারে বালি তোলে তখন আশপাশের উচু স্থান ভেঙ্গে নদী তার গর্তের ঘাটতি পুরণ করে। এভাবেই সৃষ্টি হয় ভাঙ্গনের।
সরেজমিনে দেখা মিলে ঘোড়াউত্রা নদী তীরবর্তী এলাকাবাসীর বসতভিটে ও ফসলি জমি বিলুপ্তির পথে। স্থানীয়দের ভাষ্য এ সবের জন্যে দায়ী স্থানীয় বালু খেকোরা। যদিও বিগত আ’লীগ সরকার হাওর রক্ষা ও বাধ প্রকল্পের নামে শতশত কোটি ব্যয় দেখিয়েছেন ভাঙ্গন রোধের লক্ষ্যে। এসব কাজ চলমান রয়েছে জেলার অসংখ্য ছোট-বড় প্রজেক্টের মাধ্যমে। জানা গেছে কিশোরগঞ্জের ১০টি উপজেলায় নদীতীর প্রতিরক্ষা কাজের, ওয়েভ প্রটেকশন এবং খাল পুনঃখনন প্রকল্পের মধ্যে ১৫ জুলাই, ২০২৩ সালে যে কয়টি কাজ স্থানীয় সংসদ আফজাল হোসেনের মাধ্যমে উদ্বোধন হয় এসবের মধ্যে ছাতিরচর গ্রামে ১৪০০ মিটার নদী তীরবর্তী প্রকল্পের চুক্তি মূল্য- ৫২১৫.৭০ লক্ষ টাকা, সিংপুর গ্রামের ১০০০মিটারের ৩৫৫৯.৮৩ লক্ষ টাকা। সিংপুর বাজারের ১২০০ মিটারের জন্যে ৪২২৮.৯৭ লক্ষ। এরি মধ্যে জানা গেছে ছাতিরচরেই নদী তীরবর্তী রক্ষায় ৬০ কোটি টাকার কাজ চলমান আছে। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. আতিকুর রহমান (এসডিই) এর দেয়া তথ্যমতে শুধু নিকলীতেই সর্বশেষ পানি উন্নয়ন বোর্ডেরই ৩.৬০ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা কাজের চুক্তিমূল্য ১৩০.০৪ কোটি টাকা। যা ৩০ শে জুনের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজের মানের বিষয়ের পাশাপাশি সমালোচনা উঠেছে যথা সময়ে সমাপ্তি নিয়েও। এসব মেগা প্রকল্পে কোন কাজ এখনো দৃশ্যমান হয়নি বলে জানান স্থানীয়রা।
সাফল্য-ব্যর্থতার ধারাবাহিকতার সরল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের জাতীয় উন্নয়নে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে রোল মডেল। যোগাযোগ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যে উন্নয়ন ঘটে তা তুলে ধরা হয় অভাবনীয় কিন্তু এর নেপথ্যে শুরু হয় সাগরচুরি। প্রকল্পের নামে সর্বত্রই চলে লুটপাটের মহোৎসব। উন্নয়নের ধারায় গতি বাড়াতে গিয়ে দুষ্টচক্রের পরামর্শে সরকার জাতীয় রিজার্ভে পর্যন্ত হাত দেয়। এক সময় রিজার্ভ হয়ে পড়ে রুগ্ন, জীর্ণ-শীর্ণ। অপরদিকে অর্থপাচারের মধ্য দিয়ে সকল স্তরের সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হয়ে ওঠেন শত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা চক্রটি ৫ আগষ্টের পর থেকে সমুদ্র ও আকাশপথে কেউ বিদেশে পালাচ্ছে কেউবা গভীর গর্ত-অরণ্যে গা ঢাকা দিয়েছে। বাংলাদেশের আর্থিক খাত ধ্বংসের ইতিহাস রচিত হয় এভাবেই। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রমে হাত দেয়। এ সময়ে সকল দল-মত এক কাতারে দাঁড়ায়। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সর্ববৃহৎ দল বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে সরকারকে সহযোগিতার কথা বললেও এখন দলের নেতাকর্মীদের একটি অংশ অনুচিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকেরও বেশি সময়ে সারাদেশে একচ্ছত্র প্রভাব ও দাপিয়ে বেড়ানো নেতাকর্মীরা এখন অধিকাংশই পালিয়ে আছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন আর প্রতিবাদের ভাষা স্তব্ধ করার এই সর্বনাশী প্রক্রিয়া এতটাই জোরালো করা হয়েছিল যে, দেশের জনগণ হয়ে পরে তখন গিনিপিগ। ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্টের সূচনা লগ্নটি ছিল এমনই। জনসাধারণ স্বস্তির মুখ দেখার অপেক্ষায় থাকলেও দেড় দশক গর্তে লুকিয়ে থাকা ক্ষুধার্ত মানুষগুলো যেন ভুঁড়িভোজে নামছে এমনি তথ্য মিলে হাওরের নদ-নদী ও চরের জবরদখল আর অবৈধ হস্তক্ষেপ ও নানান অবৈধ বানিজ্যের দিকে তাকালে।
দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলেও থেমে নেই বালু খেকোদের দৌরাত্ম্য। ছাত্র-জনতার রক্তঝরা আন্দোলনে টানা চতুর্থ মেয়াদে থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও গণতন্ত্রের অজেয় শক্তির কাছে দলীয় শক্তির বিপর্যয়ের এই ইতিহাস থেকেও শিক্ষা নিতে পারছে না টানা ১৫ বছরের সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। রাষ্ট্র সংস্কারের পক্ষে নিজেদের অবস্থানের কথা জানালেও মাঠের চিত্র ভিন্ন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিলক্ষিত হচ্ছে আওয়ামী লীগের হাওরের সাম্রাজ্য দখলে নিচ্ছে বিএনপি। এ যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এটি আমাদের সমাজের কলঙ্কিত এক নৈমিত্তিক ইতিহাসের দৃশ্যপট! এমনি দৃশ্য চোখ মেললেই ধরা গোড়াউত্রা নদীর বুকে বালিমাটি উত্তোলনের বুট আর ড্রেজারের দৃশ্যে। এমন অনেক দৃশ্যে সাধারণের ভাষ্যমতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ফল হয়েছে শুধু অবৈধ ক্ষমতাধরের হাতবদল। গরিবের ভাগ্যের পরিবর্তন এখনো আসেনি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেখানে বিধ্বস্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ ও অর্থনীতির মেরুদণ্ড বিনির্মাণে কাজ করছে সেখানে দেড় দশকের বেশি সময় রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই সর্বত্র স্থানীয়ভাবে নদীর বালি মাটির দখলবাজিতে নেমেছে যা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কঠোর হুঁশিয়ারি বার্তা ও বহিষ্কারের মতো শাস্তির খড়গেও প্রত্যাশিত মাত্রায় থামানো যচ্ছে না বলেও গুঞ্জন উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়দের তথ্যমতে সিংপুর ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি হারুন অর রশিদসহ জড়িত রয়েছেন শান্তি রহমান ও আবুল্লা সর্দার। তবে মুঠোফোনে হারুন অর রশিদ ও আবুল্লা সর্দার বালু উত্তোলন বিষয়ে কিছু জানা নেই উল্লেখ করে তথ্য দিতে নারাজ। এদিকে ধানা বিএনপি সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পরিচয়ে শান্তি রহমান বালি উত্তোলন হচ্ছে স্বীকার করলেও তিনি প্রতিবাদ করেছেন বলে জানান। বালি উত্তোলনে জড়িত নন। স্থানীয় হদয়, খোকন ফকরুলসহ অন্তত চারজন বালি উত্তোলনে জড়িত বলে তিনি নিশ্চিত করেন। তবে বিএনপির কর্মী সমর্থক দাবিদার হৃদয় মুঠোফোনে বালি দিয়েছেন জিও ব্যাগের জন্যে এ কথা স্বীকার করলেও ধনু নদীর পূর্ব পাড়ের হেমারচর অংশ থেকে তিনি বালি উত্তোলন করেননি বলে দাবি তোলেন।
নিকলী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক বদরুল মোমেন মিঠু বলেন, এর সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আমিও আইনি হস্তক্ষেপ কামনা করি। বালু খেকোদের জন্যেই নদী সংলগ্ন অংশের ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে থাকে। তাই দ্রুত আইনি হস্তক্ষেপ কামনা করি। হোক সে যে কোন দলের।
নিকলী উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা পাপিয়া আক্তারের সাথে ধনু নদী থেকে বালি উত্তোলনের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে তোলে ধরা হলে জবাবে তিনি বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলেও জানান। পাশাপাশি প্রশাসনকে ম্যানেজ করে প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা বালি মাঠি উত্তোলন করে চলেছেন এ প্রশ্নের জবাবে- কথাটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বলে উড়িয়ে দেন।
কিশোরগঞ্জের নিকলীর সিংপুরের ধনু নদীর পূর্ব পাড়ের হেমারচর ঘেঁষে অবৈধ উপায়ে ২৭ ডিসেম্বর থেকে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের বালি উত্তোলনের বিষয়ে জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খাঁনকে জানানো হলে তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলেও জানান।