
আমার কাগজ প্রতিবেদক
২০২০ সালের ১৫ মার্চ। ঘটনাস্থল রাজধানীর জুরাইন। পূর্ব জুরাইনের কুসুমবাগ মাদরাসা থেকে ফিরছিল তিন কন্যাশিশু। দুজনের বয়স পাঁচ, একজনের সাড়ে চার। ঠিক সন্ধ্যায় ফেরার পথে তিন শিশুকে চকলেট, চিপস খাওয়ানোর কথা বলে নিজের বাড়ি ডেকে নিয়ে দুজনকে ধর্ষণ করেন প্রতিবেশী মো. সুলতান। এ ঘটনার পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি বিচার।
ন্যায়বিচারের আশায় আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন মামলার বাদী ভুক্তভোগী শিশুর বাবা। ধর্ষণের শিকার দুই শিশুর একজন তার মেয়ে এবং অন্যজন তার ভায়রার মেয়ে।
জানা যায়, ঘটনার পরদিন রাজধানীর কদমতলী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী শিশুর বাবা। ওই দিনই (১৬ মার্চ) আসামি মো. সুলতান গ্রেফতার হন। ধর্ষণে অভিযুক্ত সুলতান মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান থানার কোলাগ্রামের মৃত লাট মিয়ার ছেলে। গ্রেফতারের পর তাকে একদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এরপর থেকেই কারাগারে আটক আছেন তিনি। কয়েক দফা জামিন আবেদন করলেও তা নামঞ্জুর হয়।
আমি ধর্ষকের কঠিন বিচার চাই, ফাঁসি চাই। আমার মেয়েটা এখনো সেই মানসিক ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এখনো ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না। স্কুলে ঠিকমতো যায় না। যে আমার এত বড় ক্ষতি করেছে, তার কঠিন বিচার চাই আমি।–ভুক্তভোগীর বাবা
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ভুক্তভোগী দুই কন্যাশিশু রাজধানীর কদমতলীর কুসুমবাগ মাদরাসার শিশু শ্রেণিতে পড়তো। ২০২০ সালের ১৫ মার্চ সন্ধ্যা আনুমানিক সাড়ে ৬টার দিকে মাদরাসা থেকে পূর্ব জুরাইনের বাসায় যাচ্ছিল ভুক্তভোগী দুজনসহ তিন শিশু। তারা বাসায় যাওয়ার পথে প্রতিবেশী সুলতানের (৪২) বাসার সামনে পৌঁছালে সুলতান তাদের ডাক দেন।
একপর্যায়ে অভিযুক্ত তাদের বলেন ‘তোরা কী খাবি, আমার সঙ্গে চল আমি খাওয়াবো।’ একথা বলে তিনজনকে তার বাসায় নিয়ে যান। পরে সাড়ে চার বছর বয়সী শিশুটিকে ১০ টাকা দেন এবং পাঁচ বছর বয়সী অন্য দুই শিশুকে ধর্ষণ করেন সুলতান।
এজাহার সূত্রে আরও জানা যায়, কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে ছাড়া পাওয়া একজন শিশু তার মাকে গিয়ে সবকিছু জানায়। এরপর শিশুটির মা লোকজন নিয়ে ধর্ষণের শিকার দুই শিশুকে উদ্ধার করে। পরে তাদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মামলাটি আটমাস ধরে তদন্ত করে ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা কদমতলী থানার উপপরিদর্শক মো. সাহিদ হাসান। অভিযোগপত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ২০২০ সালের ১৫ মার্চ মাদরাসা থেকে ফেরার পথে চকলেট, চিপস ও আচার খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে তিন শিশুকে ডেকে নেন আসামি সুলতান। পরে এক শিশুকে বের করে দিয়ে পাঁচ বছর বয়সী অপর দুই শিশুকে ধর্ষণ করেন তিনি।
মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ পর্যায়ে। শিগগির বাকি সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করা হবে। আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতে রাষ্ট্রপক্ষ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। আশাকরি ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাবে এবং আসামি সুলতানের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হবে।- পিপি মো. সাজ্জাদ হোসেন (সবুজ)
অভিযোগপত্র দাখিলের পরের বছর মামলাটির অভিযোগ গঠন করে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করেন আদালত। এর মাধ্যমেই শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। ভুক্তভোগী দুই শিশু জবানবন্দি দেয়। এক শিশু জবানবন্দিতে বলে, ‘ঘটনার দিন খাবার খাওয়ানোর কথা বলে সুলতান তার বাড়ির মধ্যে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর রুমের মধ্যে নিয়ে ধর্ষণ করে। এসময় আসামি সুলতানের মেয়ে পাশের রুমে খেলাধুলা করছিল। সুলতানের বউ তখন বাড়ি ছিল না।’
মামলাটি এখন ঢাকার নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক মোসা. রোকসানা বেগম হ্যাপীর আদালতে বিচারাধীন। এখন পর্যন্ত মামলায় নয়জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আগামী ৪ মে মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। এরপর অবশিষ্ট সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মামলার পরবর্তী ধাপ হিসেবে আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন শুনানি হবে। এরপরই অনুষ্ঠিত হবে উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন। তারপর ঘোষণা করা হবে রায়। তবে রায় পর্যন্ত যেতে আরও অপেক্ষায় থাকতে হবে বাদীপক্ষকে।
বিচারিক আদালতের রায়ে যদি সাজা ঘোষণা করা হয় এবং আসামিপক্ষ রায়ে যদি সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারেন। সেক্ষেত্রে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পাড়ি দিতে আরেকটি দীর্ঘ পথ।
পাঁচবছর ধরে শিশুকন্যা ধর্ষণের দগদগে ক্ষত বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা শিশুটির বাবা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি ধর্ষকের কঠিন বিচার চাই, ফাঁসি চাই। আমার মেয়েটা এখনো সেই মানসিক ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এখনো ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না। স্কুলে ঠিকমতো যায় না। যে আমার এত বড় ক্ষতি করেছে, তার কঠিন বিচার চাই আমি।’
সংশ্লিষ্ট আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. সাজ্জাদ হোসেন (সবুজ) জাগো নিউজকে বলেন, ‘মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। শিগগির বাকি সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করা হবে। আসামির সর্বোচ্চে শাস্তি নিশ্চিতে রাষ্ট্রপক্ষ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। আশাকরি ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাবে এবং আসামি সুলতানের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হবে।’