আমার কাগজ ডেস্ক
বাংলাদেশে সম্প্রতি যখন সহিংস বিক্ষোভ চলছে, এরইমধ্যে সময় একজন হিন্দু ব্যক্তির হত্যাকাণ্ড ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে চলমান টানাপোড়েনকে আরো গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
একে অপরের বিরুদ্ধে সম্পর্ক অস্থিতিশীল করার অভিযোগ তুলতে থাকায়, একসময়ের ঘনিষ্ঠ ও সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক মেরামত-অযোগ্য হয়ে পড়ছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
একটি হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো বিক্ষোভ শুরু করেছে। নিহত ২৭ বছর বয়সী দিপু চন্দ্র দাস বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে গত সপ্তাহে ময়মনসিংহে একদল লোক তাকে পিটিয়ে হত্যা করে।
রাজধানী ঢাকায় আলোচিত ছাত্রনেতা শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সহিংস বিক্ষোভ শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে ঘটনাটি ঘটে।
হাদির সমর্থকদের অভিযোগ, হাদি হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন ব্যক্তির সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের যোগসূত্র আছে এবং তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন, যা মুসলিম-প্রধান বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব আরও উসকে দিয়েছে।
তবে বাংলাদেশের পুলিশ জানিয়েছে, সন্দেহভাজন ব্যক্তির দেশ ছাড়ার বিষয়ে কোনো নিশ্চিত কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ দু’টি দিল্লিসহ কয়েকটি শহরে ভিসা সেবা স্থগিত করেছে এবং একে অন্যের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক মিশনগুলোর পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ তুলেছে।
নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ জানাতে দুই দেশই হাইকমিশনারদের তলব করেছে।
আমি আন্তরিকভাবে আশা করি কোনো পক্ষেই উত্তেজনা আর না বাড়ুক, বিবিসিকে বলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস।
তার মতে, বাংলাদেশের ‘অস্থির পরিস্থিতি’ ভবিষ্যতে কোন দিকে মোড় নেবে তা অনুমান করা কঠিন করে পড়েছে।
বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব নতুন না। বাংলাদেশিদের একটি অংশ তাদের দেশে ভারতের কর্তৃত্ববাদী প্রভাব রয়েছে দাবি করে সবসময়ই বিরক্তি প্রকাশ করে আসছেন। বিশেষ করে গত বছর গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে তা আরও বেড়েছিল বলে মনে করেন তারা।
শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে এই ক্ষোভ আরও বেড়েছে। ঢাকা থেকে একাধিকবার অনুরোধ জানানোর পরও এখন পর্যন্ত তাকে ফেরত পাঠাতে সম্মত হয়নি দিল্লি।
হাদির হত্যাকাণ্ডের পর কয়েকজন তরুণ নেতার ভারতবিরোধী উসকানিমূলক বক্তব্য নিয়ে খবরও প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকায় বিক্ষোভকারীরা ভারতীয় হাইকমিশনের দিকে মিছিল নিয়ে গেলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে তাদের ঠেকাতে হয়েছে।
গত সপ্তাহে চট্টগ্রামে ভারতের সহকারী হাইকমিশন ভবনে একদল লোক পাথর নিক্ষেপ করলে দিল্লিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ ১২ জনকে আটক করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না এনে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতে পাল্টা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। দিল্লিতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের বাইরে একটি হিন্দু গোষ্ঠীর বিক্ষোভে তীব্র আপত্তি জানিয়ে একে ‘অযৌক্তিক’ বলে অভিহিত করে বাংলাদেশ।
সাবেক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, দুই পক্ষের মধ্যে এ ধরনের সন্দেহ ও অবিশ্বাস আমি আগে কখনো দেখিনি। তার মতে, প্রতিষ্ঠিত কূটনৈতিক রীতিনীতি অনুযায়ী উভয় দেশেরই কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত।
বাংলাদেশে পোশাক কারখানার কর্মী দিপু চন্দ্র দাসকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ভারতে ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নবী মুহাম্মদকে অবমাননার অভিযোগে একদল লোক তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে তার দেহ একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যা সীমান্তের দুই পাশেই তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়।
নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছে, নতুন বাংলাদেশে এ ধরনের সহিংসতার কোনো স্থান নেই। হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না—এমন আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে।
দিপু চন্দ্র দাস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ১২ জনকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশি পুলিশ।
বিশ্লেষকদের মতে, এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশে আবারও সংখ্যালঘু ও অধিকার কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। শেখ হাসিনার পতনের পর ধর্মীয় মৌলবাদীরা আরও আত্মবিশ্বাসী ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে বলেও মনে করছেন তারা।
কট্টর ইসলামপন্থিরা শত শত সুফিদের মাজার ভাঙচুর করেছে, হিন্দুদের ওপর হামলা চালিয়েছে, কিছু এলাকায় নারীদের ফুটবল খেলতে বাধা দিয়েছে এবং সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও কমিয়ে দিয়েছে।
গত এক বছরে বাংলাদেশে বাড়তে থাকা গণপিটুনির ঘটনা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশি রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিফ বিন আলী বলেন, সমাজের কট্টরপন্থি অংশ এখন নিজেদের মূলধারা মনে করছে, আর তারা দেশে বহুত্ববাদ বা মতের বৈচিত্র্য দেখতে চায় না।
এই চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলো মানুষ ও প্রতিষ্ঠানকে ‘ভারতপন্থি’ আখ্যা দিয়ে অমানবিক করে তুলছে। এতে মাঠপর্যায়ে অন্যদের জন্য তাদের ওপর হামলা চালানোর এক ধরনের সবুজ সংকেত তৈরি হচ্ছে, বলেন তিনি।
বাংলাদেশের অনেকের ধারণা, গত সপ্তাহে দু’টি পত্রিকা অফিস ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো এবং একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে ভারতপন্থি আখ্যা দিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় চরম ইসলামপন্থিরাই জড়িত ছিল।
সাম্প্রতিক সহিংসতা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করেছেন সামাজিক অধিকারকর্মীরা। বিক্ষোভ শুরুর আগেও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে না পারায় সমালোচনার মুখে পড়ে এই সরকার।
অশোক সোয়াইনসহ একাধিক বিশ্লেষকের মতে, দুই দেশের ডানপন্থি নেতারাই নিজেদের স্বার্থে উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, যা উত্তেজনা ও জনরোষ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘাত গবেষণার অধ্যাপক অশোক সোয়াইন বলেন, ভারতের গণমাধ্যমের একটি বড় অংশও বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করছে এবং দেশটি সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে দেখাচ্ছে।
মানুষের বোঝা উচিত, বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বলেন তিনি।
ঢাকায় অন্তর্বর্তী প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ ও বৈধতার ঘাটতি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ায়, একটি নির্বাচিত সরকারই যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেশি সক্ষম হবে—এ বিষয়ে ব্যাপক ঐকমত্য রয়েছে।
বাংলাদেশে ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। তবে ততদিন পর্যন্ত আরও সহিংসতা এড়ানোই মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ।
শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়ায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)- ই বিজয়ী হবে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে জামায়াতে ইসলামীর মতো ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
ভারতবিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে কট্টর ধর্মীয় দলগুলো পরিস্থিতি উসকে দিতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকে সামনের দিনগুলোতে আরও সহিংসতা ঘটার উদ্বেগ রয়েছে।
আসিফ বিন আলী সতর্ক করে বলেন, এই ভারতবিরোধী রাজনীতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী ভারত নয়, বরং বাংলাদেশের নাগরিকরাই—যেমন ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারার মানুষ, মধ্যপন্থি ও সংখ্যালঘুরা।
তিনি বলেন, বর্তমান বয়ান এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, যারা বা যে প্রতিষ্ঠান মৌলবাদীদের সমালোচনা করে, তাদের ‘ভারতপন্থি’ আখ্যা দিয়ে সহজেই তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে ফেলা যায় এবং তাদের ওপর হামলাও যৌক্তিক বলে তুলে ধরা যায়।
ভারতের নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশে পরিবর্তিত বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন।
ভারতের পার্লামেন্টের একটি প্যানেল বলেছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্রগতি বা পরিস্থিতি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দিল্লির জন্য ‘সবচেয়ে বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ’ তৈরি করেছে।
হুমায়ুন কবিরের মতো বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিকদের মতে, ভারতকে মাঠের বাস্তবতা মেনে নিয়ে আস্থা পুনর্গঠনের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
আমরা প্রতিবেশী এবং একে অপরের ওপর নির্ভরশীল, বলেন তিনি।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ করার ইঙ্গিত দিয়েছে দিল্লি, যা কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠনের পথ তৈরি করতে পারে। ততদিন পর্যন্ত রাজপথের ক্ষোভ যেন দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও চাপে না ফেলে সে বিষয়ে সতর্ক করছেন দুই দেশের বিশেষজ্ঞরা।
তথ্যসূত্র: বিবিসি
