দীপক কুমার আঢ্য
টেকসই উন্নয়ন ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা- শিক্ষা মানুষের মধ্যে জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ তৈরি করে, যা ভবিষ্যতের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। তবে টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় একটি পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। ভবিষ্যতের রূপরেখা অনুধাবন, সিদ্ধান্তগ্রহণ এবং ক্রিটিক্যাল থিংকিং-এর দিকে লক্ষ্য রেখে শিক্ষার মান উন্নয়ন করা প্রয়োজন যা কিনা ভবিষ্যতে এই উন্নয়নকে টেকসই উন্নয়নের দিকে পরিচালিত করবে।
শিক্ষিত জনশক্তি টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত:
একটি জাতিকে গড়ে তুলতে হলে প্রথম সোপান হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাই জাতির দেরুদন্ড। আমরা যদি বাংলাদেশের চির অবহেলিত দারিদ্র্যপীড়িত অসহায় জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি ও সার্বিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করি তাহলে শিক্ষাই হচ্ছে পূর্বশর্ত। বঙ্গবন্ধুর জীবনব্যাপী সংগ্রামের সাধনা ছিল, বাংলার মানুষের স্বাধীনতা। তিনি বলেছেন- ‘আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন খাদ্য পায়, বস্ত্র পায়, বাসস্থান পায়, শিক্ষার সুযোগ পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়। জাতির জীবনে শিক্ষার অসীম গুরুত্ব সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুই আমাদের পথ প্রদর্শন করে গেছেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই জাতির জন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
এই লক্ষ্যে তিনি শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বঙ্গবন্ধুর নিকট পেশ করেন। জাতির দুর্ভাগ্য, সেই মূল্যবান রিপোর্ট-এর সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করার সময় তিনি পাননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের কালো রাত্রিতে স্বাধীনতা বিরোধীচক্র ও তাদের দেশীয় এজেন্টরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শহিদ হবার পর পর্যায়ক্রমিকভাবে যারা ক্ষমতায় আসে তারা এ বিষয়ে আর কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করে নাই। অথচ সেই গুরুত্বপূর্ণ দলিল থেকে এখনও আমরা অনেক বিষয়ে দিকনির্দেশনা পেতে পারি ।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রশ্নে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ব্যর্থতা থেকে আমাদের অনেকের মনেই স্থিরবিশ্বাস জন্মেছে যে শিক্ষাহীন নিরক্ষর জাতিকে নিয়ে আমরা বেশি দূর অগ্রসর হতে পারব না। শিল্পায়ন, কৃষির আধুনিকীকরণ, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি প্রযুক্তি আহরণ ও প্রয়োগ, রপ্তানি বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব দূরীকরণ- বস্তুত জাতিগঠন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুততর করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি বিষয়ে আমাদের বিশাল নিরক্ষর জনসংখ্যা ও শিক্ষার নিম্নমান একটা বড় প্রতিবন্ধক হিসাবে দেখা দিয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার উদাহরণ দিতে চাই না। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই আমরা উপলদ্ধি করতে পারি, শিক্ষার উন্নয়নের গভীর ও প্রত্যক্ষ যোগসূত্র।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে জাপান যখন শিল্পায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করে তখন সে দেশে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার আলো সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌছে গিয়েছিলাম। জাপানের সাধারণ মানুষও তখন পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কারিগরি প্রযুক্তি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত ছিল। পরবর্তীকালে এই শতাব্দীর মধ্যভাগে, কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও গণচীনে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সূচনাতেই সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা ও নিরক্ষরতা দূরীকরণ কার্যক্রমকে বাস্তবায়িত করা হয়েছে। এর ফলে এসব দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড গতিশীলতা এসেছে এবং তারা দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ও বাজার অর্থনীতির সমন্বয় সাধন করে চীন সমগ্র জাতির কর্মশক্তি ও সৃজনশীলতাকে জাতি গঠন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিয়োজিত করেছে। তাদের সাফল্যের অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের দক্ষ, শিক্ষিত ও পরিশ্রমী জনশক্তি। শুধু পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় নয়, দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হয়, এই উপমহাদেশের অন্যান্য দেশগুলোও শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। এরই পাশে আমরা বাংলাদেশে দ্রুতবর্ধমান নিরক্ষর জনসংখ্যা নিয়ে নিদারুণ দারিদ্র্যের তাড়নায় আবর্তিত হচ্ছি।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং স্তরে জটিল সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যা তীব্রভাবে বিরাজমান প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে। শিক্ষা পদ্ধতি, স্কুলগুলির দৈন্যদশা, শিক্ষক-শিক্ষিকার অপ্রতুলতা, সর্বোপরি অপর্যাপ্ত স্কুল, গ্রামবাসীর আর্থিক দীনতা, যাতায়াতের অব্যবস্থা, সবকিছু মিলিয়ে এক করুণ অবস্থা বিরাজমান। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতাকেই আমি আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা দীর্ঘস্থায়ী, মৌলিক ও জরুরি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করব। টেকসই উন্নয়নের জন্য সর্বপ্রথম বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সময়ের সাথে উন্নত ও আধুনিক করতে হবে।
লেখক: ব্যাংকার, ফ্রিল্যান্স লেখক ও গবেষক।