ঝালকাঠি প্রতিনিধি
টানা ঝড়বৃষ্টির রাত শেষ হলেও ঝালকাঠিতে থামেনি ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাব। দমকা বাতাস আর বৃষ্টির সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেছে নদী তীরবর্তী গ্রামের অধিকাংশ এলাকা। সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়েছে ৬ থেকে ৭ ফুট। ফলে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কাঁঠালিয়ায় বিষখালি নদীর পাড়ে বেড়িবাঁধ না থাকায় নদীর পাশে থাকা শতাধিক গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। জেলার প্রায় ২-৩ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
মূল্যবান জিনিসপত্র ও গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ৪ হাজারের মতো মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। বিষখালীর পূর্বপাশে দেউরী সাইক্লোন শেল্টার, পশ্চিম তীরে সাচিলাপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজেও আশ্রয় নিয়েছেন নদী তীরের বাসিন্দারা। গবাদি পশু ও মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপদ উঠেছেন তারা। ঘূর্ণিঝড় থামলে ও পানি নামলে তারা বাড়ি ফিরবেন।
রোববার (২৬ মে) সকাল ১০টা থেকে ঝালকাঠিকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়। বিকেল ৫টার দিকে চরভাটারাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিতে দেখা যায় স্থানীয়দের। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষদের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। রাত থেকে মঙ্গলবার (২৮ মে) বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ঝড়ো হাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে প্রায় তিন শতাধিক গাছ উপড়ে পড়েছে। এতে অনেক জায়গায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
সরেজমিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিষখালী নদী তীরবর্তী চরভাটারাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টারে গরু, হাঁস-মুরগি ও মূল্যবান সম্পদ নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ওই এলাকার নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্করা আশ্রয় নিয়েছেন। তবে ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চাষিরা।
জেলার দুর্গম এলাকা কাঁঠালিয়ার উপজেলা পরিষদেও পানি ঢুকে পড়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, বসতঘর, মাছের ঘের ও ফসলের মাঠ। এতে লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাছ ব্যবসায়ীরা। জেলার বিভিন্ন এলাকায় মাছের ঘের, ফসলের মাঠ তলিয়ে গেছে এতে কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
আশ্রয়কেন্দ্রের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন স্থানীয় দফাদার তোফাজ্জেল হোসেন, চৌকিদার রুহুল আমীন, রুবেল মাঝি, আনসার সদস্য রবিউল ইসলাম, বিথি খানম, এমদাদুল হক মিলন, রিফাত খান।
তারা জানান, প্রতিবার বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা দেখলেই আড়াই শ থেকে তিনশ নারী-পুরুষ তাদের সম্পদ নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আসেন। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
কাঁঠালিয়া উপজেলার লঞ্চঘাট এলাকার বাসিন্দা নুরুল হক বলেন, রাতেই আমার ঘরে পানি উঠছে। এখানে কোনো বেড়িবাঁধ নেই। তাই জোয়ার হলেই পানি ওঠে। এখন বন্যার পানিতে কোমর সমান তলিয়ে আছে। ঘরের মালামাল কিছুই রক্ষা করতে পারব না। সবই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কাঁঠালিয়ার জয়খালী এলাকার বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা ঘূর্ণিঝড় শুনলেই আতঙ্কে থাকি। এখন নাকি ঘূর্ণিঝড় রেমাল চলে। নদীর পানিতে এলাকা তলিয়ে গেছে। অনেক ঘরে পানি ঢোকে গেছে। পানি যেভাবে বাড়তে শুরু করেছে আর যদি আধা ফুট বাড়ে, তাহলে আমার ঘরেও পানি ঢোকে যাবে।
ঝালকাঠি শহরের পৌরসভা খেয়াঘাট এলাকার বাসিন্দা নুপুর বেগম বলেন, আমার বসতঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। রাতে আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছি, সকালে এসে দেখি ঘরের মালামাল সব পানিতে ডুবে আছে। এখনো পানি নামেনি। সব মালামাল নষ্ট হয়ে যাবে।
নলছিটির মালিপুর গ্রামের মো. হাবিবুর রহমান বলেন, আমি খেটে খাওয়া মানুষ। আমার ঘরের মধ্যে হাঁটু সমান পানি উঠছে। এখন মালামাল সব ভিজে গেছে। রান্না, খাওয়াদাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। কেউ সাহায্যও দেয়নি।
রাজাপুরের ছোট কৈবর্ত খালী গ্রামের ষাটোর্ধ্ব চন্দ্রবান বিবি বলেন, পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। রান্না করতে পারিনি। দুপুরেও খাইনি। এখন পাশের বাড়ির একটা ঘরে এসে উঠছি।
ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী একেএম নিলয় পাশা জানান, সুগন্ধা ও বিষখালী নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে ছয়-সাত ফুট পানি বিপদ সীমার ওপর থেকে প্রবাহিত হচ্ছে। পানিতে তলিয়ে গেছে অসংখ্য বাড়িঘর। আজকের দিনের মধ্যে পানি কমলে মানুষের ক্ষতি কম হবে।
ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক (ডিসি) ফারাহ গুল নিঝুম বলেন, ঝালকাঠিতে ৮৮৫টি আশ্রয়কেন্দ্র ও ৬২টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তুত রয়েছে ৩৭টি চিকিৎসাদল, ফায়ার সার্ভিসের ৮টি উদ্ধারকারী দল। পাশাপাশি শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ৪২৪ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছেন। তাৎক্ষণিক যোগাযোগের জন্য ছয়টি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, এখনো যারা আশ্রয়কেন্দ্র আসেনি, তারা আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে পারেন। আশ্রয়কেন্দ্রে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জেলার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। অনেকের বাড়িতে পানি উঠেছে। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে জেলা প্রশাসন থাকবে।
ঝালকাঠির পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া মানুষদের বসতঘরের মালামাল যাতে লুণ্ঠিত না হয়। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে গেছে তাদের মালামাল যাতে চুরি না হয়, সেদিকে পুলিশ কড়া নজর রাখবে।