
আমার কাগজ প্রতিবেদক
শেষ বয়সে সব শ্রেণির মানুষের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য ২০২৩ সালের অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ঘটা করে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের অর্থ সংগ্রহ শুরু করে, তখন সাথী বিশ্বাসের মত অনেকেই এতে আস্থা রাখতে পারেননি।
পেনশন স্কিম চালুর এক বছরের মাথায় শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এরপর পেনশন স্কিমের ক্ষেত্রে কী ঘটেছে সে খবর পৌঁছায়নি সাথী বিশ্বাসের মত আরও অনেকের কাছে।
এই গণমাধ্যকে বলেন, “পেনশন স্কিম সম্পর্কে শুনেছিলাম। তখন তো সরকার অভাবে পড়ে জনগণের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহের জন্য এটা-ওটা চালু করছিল। তাই বিশ্বাস করতে পারিনি। এখন তো আগের সরকারই নাই, পেনশন স্কিম আছে কি নেই সেই খবর কে রাখে।
“টাকা জমালে তো ভালোই হয়। আমরা তো বিভিন্নভাবে সঞ্চয় করি। কিন্তু পেনশন স্কিমের খবর পরে আমিও নেইনি। কেউ খবরও দেয়নি।”
গত ৫ অগাস্ট সরকার পরিবর্তনের পর সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষও এক ধরনের অনিশ্চিয়তার মধ্যে ছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পর এখন নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে পেনশন স্কিম।
কিন্তু গত পাঁচ মাসে পেনশন স্কিমে জনগণের সাড়া তলানিতে নেমেছে। হিসাব করে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের ১৭ অগাস্ট থেকে ২০২৫ সালের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে মাত্র ৮০৭ জন নতুন গ্রাহক পেয়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।
কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, গত ১৭ অগাস্ট পর্যন্ত এক বছরে জাতীয় পেনশন স্কিমে যুক্ত হয়েছেন তিন লাখ ৭২ হাজার ৪০১ জন। এদের মোট জমার পরিমাণ ১৩১ কোটি টাকা।
আর গত ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত নতুন ৮০৭ জনকে নিয়ে পেনশন স্কিমে মোট যুক্ত হয়েছেন তিন লাখ ৭৩ হাজার ২০৮ জন। জমা পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১৫৪ কোটি ১৪ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকা।
শুরুতে ‘প্রবাস’, ‘প্রগতি’, ‘সুরক্ষা’ ও ‘সমতা’ স্কিম চালু করা হয়েছিল। গত জুলাইয়ে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘প্রত্যয়’ স্কিম চালু করতে গিয়ে ধাক্কা খায় কর্তৃপক্ষ। অংশীজনদের বিরোধিতার মুখে ওই প্যাকেজ চালু করা যায়নি।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী ‘প্রবাস’ স্কিমে যুক্ত হয়েছেন ৯৪৫ জন, বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য চালু হওয়া ‘প্রগতি’ স্কিমে যুক্ত হয়েছেন ২২ হাজার ৮৪৪ জন, অনানুষ্ঠানিকখাতে কর্মরতদের জন্য চালু হওয়া ‘সুরক্ষা’ স্কিমে যুক্ত হয়েছেন ৬৩ হাজার ৩৬০ জন এবং স্বল্পআয়ের মানুষের জন্য চালু হওয়া ‘সমতা’ স্কিমে যুক্ত হয়েছেন দুই লাখ ৮৬ হাজার ১৯ জন।
উদ্বিগ্ন নয় কর্তৃপক্ষ
পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত পাঁচ মাসে পেনশন স্কিমে নতুন নিবন্ধন বেড়েছে; তবে কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়েনি। প্রচারে আমাদের গতি কম ছিল, যেটা এখন বেগবান করার চেষ্টা করছি।
“গত ৫ অগাস্টের পর সদস্যদের চাঁদা জমা দেওয়ার পরিমাণ একেবারেই কমে গিয়েছিল। কিন্তু সেটাকে আমরা কোনো সমস্যা মনে করছি না। কারণ, এমন পরিস্থিতিতে এটা হতেই পারে। আমরা নিজেরাও এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলাম। গত জুন মাসেও দৈনিক ৫ হাজারের মতো নতুন লোক পেনশন স্কিমে যুক্ত হচ্ছিলেন। জুলাই মাসে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তা কমতে শুরু করে। অগাস্টে সরকার পতনের পর প্রায় এক মাস ধরে নতুন এনরোলমেন্ট ড্রাস্টিকভাবে কমে যায়।”
পেনশন স্কিমের প্রচারে ঘাটতি রয়েছে বলে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, টেলিটকের মাধ্যমে ভয়েস মেসেজ, জিটিভি-টিস্পোর্টে প্রচার, বাংলাদেশ বেতারে খেলার ধারাবিবরণিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। দুটি বিভাগে মেলা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সব বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে মেলা করা হবে। স্থানীয় প্রশাসনকে প্রচারে যুক্ত করা হবে।”
জাতীয় পেনশন স্কিম ঘিরে অনিশ্চয়তা কাটছে
গ্রাহকদের সুবিধায় চাঁদার টাকা জমা দেওয়ার জন্য আরও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে স্কিমে যুক্ত করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “চাঁদা গ্রহণের জন্য আরও ১০টি ব্যাংক যুক্ত করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে আইএফআইসি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, ইসলামি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংক। অচিরেই এই ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আমরা চুক্তি করব। বর্তমানে ১২টি ব্যাংক ও দুটি এমএফএস (নগদ ও বিকাশ) এর মাধ্যমে গ্রাহকরা চাঁদা দিতে পারছেন।”
গ্রাহক বাড়াতে পদক্ষেপ কী?
পেনশন স্কিমের গ্রাহক বাড়াতে আগামী রোজার আগে খুব বেশি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না– এমনটাই বলছে কর্তৃপক্ষ। তবে চলতি বছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে গ্রাহক বাড়ানোর বিভিন্ন কৌশল বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন গোলাম মোস্তফা।
তিনি বলেন, “সামনে প্রবাসীদের জন্য একটা উদ্যোগ নেওয়া হবে। যারা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিদেশে যাবে, তাদেরকে ‘প্রবাস’ স্কিমে যুক্ত হতে উদ্বুব্ধ করা হবে।
“শ্রম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমরা আগাতে চাই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আগাতে চাই। প্রতিবছর ২০ থেকে ২৫ হাজার শিক্ষক এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে যুক্ত হন। তাদেরকে যদি শুরুতেই এই পেনশন স্কিমে যুক্ত করা যায় তাহলে অনেক লোক এসে যাবে। তবে রোজার আগে খুব বেশি একটা এগোনো যাবে না।”
কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করে আগাচ্ছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্রথমেই এই ধরনের টার্গেট ঠিক করতে চাই না যে, এতদিনের মধ্যে এত লাখ গ্রাহক যুক্ত করব। প্রথমেই যাদের কাছে পৌঁছানো দরকার তাদের কাছে পৌঁছাতে চাই। যাদেরকে টার্গেট করলাম তাদেরকে ধীরে ধীরে যুক্ত করব। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ করব, মন্ত্রণালয়ে এগিয়ে আসলে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে আলাপ করব।”
পরিস্থিতি স্বাভাবিক?
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার মনে করেন, এখন সব কিছুই একটু ‘স্লো যাচ্ছে’। তাই গ্রাহক কম হওয়াটাই স্বাভাবিক।
৪ ধরনের পেনশন স্কিম, যেভাবে যুক্ত হওয়া যাবে
“এটায় পুরা গতি আসতে একটু সময় লাগবে। সরকার এখন নানাদিকের অগ্রাধিকার পূরণ করতে গিয়ে কিছুটা হিমশিম খাচ্ছে। নানা জনের নানা দাবি নিয়ে তারা ব্যস্ত। তবে এখন প্রচারের ঘাটতি আছে। আর আমাদের দেশের মানুষজন তো অতটা সচেনতন নন যে, নিজেরা নিজেরা এসব করে ফেলবেন।”
ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকার কিংবা অন্য কোনো সরকার আসলে নিশ্চয়ই এদিকে নজর দেবে বলে আশা করেন সাবেক এই সচিব।