
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
“নদীর তীরে আমাগো বাড়ি জমি-জিরাত নাই। কেউ আমাগো জায়গা দিতাছে না “
“বাড়িঘর খুইল্ল্যা অন্যের জমির আইলে মাল ছামান রাখছি।”-কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের মাঝেরচর গ্রামের তিস্তা পাড়ের বাসিন্দা ফুলমতি বেগম।
ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নে তিস্তা নদীর ভয়াবহ ভাঙনে সোমবার মাত্র চার ঘণ্টায় ১৫টি বাড়ি বিলীন হয়েছে। হঠাৎ ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন মাঝেরচর ও পাশের গতিয়াসাম গ্রামের ভাঙন কবলিত পরিবারগুলো।
আশ্রয়হীন মানুষজন এখন অন্যের জমির আইল ও খোলা আকাশের নিচে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছেন।
সোমবার মাঝেরচর ও গতিয়াসাম গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ জন মানুষ নদী তীরবর্তী বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের হাহাকার আর তিস্তার তীব্র স্রোতের শব্দে জায়গাটিতে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছিল।
হতদরিদ্র ফুলমতি সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে মাথায় ও কাঁধে করে বাড়ির জিনিসপত্র সরাচ্ছিলেন। সেই সময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “কেউ আমাগো খোঁজখবর নিতাছে না।”
গতিয়াসামের ভাঙন কবলিত বক্তার মিয়া জানান, সোমবার সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নদী ভাঙনের ফলে ১৫টি বাড়ি বিলিন হয়ে গেছে। এর মধ্যে বক্তার আলী, রফিকুল খাঁ, আফতাব খাঁ, তোফাজ্জল, সিরাজ, মোন্নাফ, শাকারুল, মমিনুল, উমর আলী, সাইফুল, ছামিরুল, সাইদুল, ফারুক, শাহিন ও খলিলের বাড়ি রয়েছে।
প্রচণ্ড গরমের কারণে গাছের নিচে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলেন মাঝেরচর গ্রামের খলিল মিয়া। তিস্তার ভাঙনে সর্বস্ব হারানো এই মাঝবয়সী লোকটির কথা বলতে গিয়েই গলা ধরে আসছিল। জন্মভিটে, জমি আর ঘরবাড়ি হারিয়ে এখন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এক অচেনা অনিশ্চয়তার সামনে।
দম নিয়ে খলিল বলেন, “আমার তার সব সম্পত্তি নদী খেয়ে গেছে। ভিটার মায়া ত্যাগ করে এবার অন্য জেলায় চলে যেতে হচ্ছে। দুই ছেলে শাহীন আর ছামিউলের সঙ্গে রাতভর আসবাবপত্র, ঘর টানছি। এমন দ্রুত ভাঙছিল যে, দম নেওয়ার ফুসরত ছিল না।
“এখন তিন বাপ-বেটা মিলে পার্শ্ববর্তী লালমনিরহাট জেলার গোকুন্ডা ইউনিয়নে ৭০ হাজার টাকায় জমি কবলা নিছি। এখন থেকে সেখানেই থাকব।”
তিনি বলেন, গতিয়াসামের অধিকাংশ মানুষ একই ইউনিয়নের সরিষাবাড়ি বাঁধে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানেও জায়গা মিলছে না। যাদের সামর্থ্য আছে তারা পাশের রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার চর ঢুষমারা ও চর গণাইয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ লালমনিরহাট জেলার গোকুন্ডা ইউনিয়নে আশ্রয় নিয়েছে।
তিস্তা নদী ঘেঁষা নেয়া চর খিতাব খাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মাহবুব রশীদ বলেন, “তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া আমাদের কোন রক্ষা হবে না। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জিও ব্যাগ ফেলে এবারের মত স্কুলটি রক্ষা করতে পারলেও পরের বন্যায় কি হবে তা বলা যাচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে এই এলাকায় প্রায় দেড়শ বাড়িঘর ভাঙনের ফলে লোকজন এলাকা ছেড়ে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরেছেন। বর্তমানে স্কুলে ৮৬ জন শিক্ষার্থী থাকলেও এখন স্কুলে শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। ভাঙনের আতঙ্কে অনেক শিক্ষার্থী স্কুল বিমুখ হয়েছে।”
রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার সহিদুল ইসলাম বলেন, “গত ৪দিনে তিস্তা নদীর তীব্র ভাঙনে প্রায় ৭০টি বাড়ি বিলিন হয়ে গেছে। আমরা শনিবার ২৫টি বাড়ির তালিকা করে উপজেলা পরিষদে আবেদন করেছি। এখন পর্যন্ত খিতাব খাঁয়ে চারটি ও চর গতিয়াসামে ছয়টি বাড়িতে অর্থ ও ঢেউটিন বিতরণ করা হয়েছে। বাকিরা এখন হা-হুতাশ করছে।”
রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশাদুল হক বলেন, “আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত ৬৩টি বাড়ি ভাঙনের তথ্য রয়েছে। আমরা প্রতিটি ভাঙন কবলিত পরিবারকে মাথা পিছু ৩০ কেজি করে চাল সহায়তা দেব।”
এছাড়াও যারা খাদ্য সংকটে ভুগছেন বা কারো কোন সহায়তা লাগলে তাদের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাসও দেন ইউএনও।