মহিনউদ্দিন চৌধুরী লিটন
২০০৪ সালের ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় পার্টির অফিসের কাজ শেষ করে সবাই বাসায় চলে আসি। কে জানত সেদিনই মাহবুব ভাইয়ের পার্টির অফিসে জীবনের শেষ দিন। আমাদের ২৮/সি, টয়েনবি সার্কুলার রোড, মতিঝিলের অফিসটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য মালিকদের সাথে কথা হয়েছে। মাহবুব ভাই আমাকে পল্টনে ভাড়া নেওয়ার জন্য একটি অফিস খোঁজ নিতে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। পরের দিন সেই বিষয়ে জানানোর কথা। কিন্তু আর সেটি জানানো হয়নি। রাত ১০টা ৪০ মিনিট মাহবুব ভাইয়ের বাসা থেকে আমাকে ফোনে জানানো হলো মাহবুব ভাই আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে আছেন। সাথে সাথে আমি ঢাকা মেডিক্যালে রওনা হই। পার্টির ঢাকার নেতাদের অবহিত করি। আমি ঢাকা মেডিক্যালে পৌঁছার কিছু সময়ের মধ্যে ভাবি (কামরুন্নাহার বেবী) পৌঁছলেন। আমরা জরুরি বিভাগে খবর নেওয়ার পর তারা আমাদের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে খোঁজ নিতে বলে। আমরা ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে মাহবুব ভাইকে পেলাম। আমরা পৌছানোর কিছু সময়ের মধ্যেই মাহবুব ভাইয়ের রক্তবমি হলো। আমরা সেখান থেকে তাকে শমরিতা হসপিটালে নিয়ে গেলাম ।
শমরিতা হসপিটালের মালিক ডা. হারুন মাহবুব ভাইয়ের কর্মী ছিলেন। তাঁকে রাতেই জানানো হলো। কিন্তু শমরিতায় মাহবুব ভাইয়ের যথাযথ চিকিৎসা হয়নি। পরদিন যখন অবস্থা খারাপের দিকে তখন আমরা তাকে বাংলাদেশ মেডিক্যালের আইসিইউতে নিয়ে যাই। সেখানেই ডা. কনক কান্তি বড়ুয়াসহ অন্য ডাক্তাররা মিলে সিদ্ধান্ত নেন রাতে ব্রেনে অস্ত্রোপচার করা হবে। রাতেই তাকে মেট্রোপলিটন হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো এবং ব্রেনের সফল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করা হলো। সেখানে চিকিৎসা শেষে বিএমআইইউ এবং পরে বারডেমে চিকিৎসা শেষে বাসায় নেওয়া হয়। বাসা থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কানাডায় নেওয়া হয়।
কানাডায় মাহবুব ভাইয়ের উন্নত চিকিৎসা হয়েছে। তিন-চারবার দেশেও এসেছেন। কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারেননি তাঁর প্রিয় বাংলাদেশে। ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর আমাদের সকলকে কাঁদিয়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন আমাদের প্রিয় আ. ফ. ম. মাহবুবুল হক।
আমাদের দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতাকে বলতে শুনি, ‘রাজনীতি করতে এসেছি ভাই কৌশলে কথা বলতে হবে, কৌশলে চলতে হবে।’ বলবেন এক কথা করবেন উল্টোটা, আ. ফ. ম. মাহবুবুল হক তার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, মন-প্রাণ দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন সেটা করার জন্য। যখন ছাত্র ছিলেন তিনি এসএসসি পরীক্ষার ফল জানার জন্য কুমিল্লা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিলেন। চেয়ারম্যান নাম, রোল নম্বর জেনে ফার্স্ট ডিভিশন থেকে থার্ড ডিভিশন পর্যন্ত ফলাফল দেখে বলেছিলেন, ‘চলে যাও, পাস করোনি ।’ তখন তিনি চেয়ারম্যানের মুখের ওপর বললেন, ‘কুমিল্লা বোর্ডে যদি একজন ছাত্রও পাস করে তবে সেটা আমি করব।’ পরে চেয়ারম্যান প্রথম স্থান অর্জনকারী থেকে দেখতে গিয়ে দেখেন যে তিনি বোর্ডে মেধাতালিকায় চতুর্থ হয়েছেন ।
রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েও কোনো দিন কোনো কাজে ফাঁকি দেননি। নিষ্ঠা, সততা, সময়ানুবর্তিতার সাথে কাজ করতেন। যখন যে কাজটা করা দরকার সেই কাজ তখনই করে ফেলতেন। পরের দিনের জন্য রেখে দেননি। মাহবুব ভাই সময়ের বিষয়ে খুবই গুরুত্ব দিতেন। সময়মতো মিটিংয়ে উপস্থিত না হওয়ায় বহু নেতাকর্মীকে তিনি মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতে দেননি। তিনি সব সময় বলতেন, ১০টা মানে ৯টা ৫৯ মিনিট ৬০ সেকেন্ড। এক সেকেন্ড পরেও কোনো কাজ শুরু করেননি ।
২০০২ সালের মাঝামঝি সময় একদিন সন্ধ্যায় মাহবুব ভাই বললেন, ‘লিটন, এক ব্যক্তি পার্টির জন্য আমার নামে একটি অ্যাকাউন্ট পে চেকের মাধ্যমে কিছু টাকা দিয়েছেন। এটা ভাঙানো যায় কীভাবে?’ আমি বললাম, কেন, অ্যাকাউন্টে জমা করে দিলেই তো ক্যাশ হয়ে যাবে। মাহবুব ভাই বললেন, ‘বোকা, আমার তো কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। থাকলে কি তোমায় প্রশ্ন করতাম।’ আমি বিস্ময়ে মাহবুব ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। পরে আমরা মাহবুব ভাইয়ের নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলি।
মাহবুব ভাইয়ের রাজনৈতিক জোয়ারের সময় আমি দেখিনি, শুনেছি বা এখনো শুনি; কিন্তু ভাটার সময় আমি তাঁর সাথে ছিলাম। একসাথে থেকেছি, খেয়েছি, এক রুমে বসে অফিস করেছি। বাংলাদেশের রাজনীতির ময়দানে মাহবুব ভাই ছিলেন ব্যতিক্রমী এক মানুষ। আমাদের পার্টি বা অফিস খরচের কোনো টাকা কোনো দিন তিনি বাকি রাখেননি, কেউ কোনো দিন বলতে পারবে না যে মাহবুব ভাই বা দলের কাছে কারো কোনো টাকা-পয়সা পাওনা আছে। সাধারণত তিনি কোনো কাজ বাকিতে করতেন না। টাকা-পয়সা দেওয়ার ব্যাপারে যখন সময় দিতেন তখনই তা পরিশোধ করে দিতেন।
মাহবুব ভাই সারা দেশের মানুষকে যেমন দলের সাথে যুক্ত করতে চাইতেন তেমনি পারিবার, আত্মীয়স্বজনকেও দলের কাজে যুক্ত করার প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। তার একমাত্র কন্যা উৎপলা ক্রান্তি ও তার বাসায় থেকে পড়ালেখা করতে আসা ভাগ্নি মনিকে মিছিল-মিটিংয়ে আসতে দেখলে তিনি খুবই খুশি হতেন। মাহবুব ভাই সর্বশেষ যখন ঢাকায় এলেন তখন তাঁর বোনেরা তার সাথে দেখা করতে এলেন। তখন বোনদের বললেন, ‘তোরা কে কে পার্টির মিটিং-মিছিলে আসিস?’ আমি বললাম, কেউ আসে না। তখন মাহবুব ভাই বললেন, ‘তাহলে আমার সাথে দেখা করে লাভ কী? পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই যদি না করো তাহলে তো তোমরা ভালো থাকতে পারবে না।’
মাহবুব ভাই অসুস্থ অবস্থায়ও এক সেকেন্ডের জন্য সমাজতন্ত্র সাম্যবাদের কথা ভোলেননি। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। তিনি বিশ্বাস করতেন, মার্ক্স-লেনিন-মাও সে তুঙের চিন্তা ও মতাদর্শের ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রই মানবমুক্তির একমাত্র পথ। অন্য কোনোভাবে মানুষের মুক্তি সম্ভব নয় ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস রচনা করলে মুক্তিযুদ্ধে মাহবুব ভাইদের ভ‚মিকা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাথে ইতিহাস হয়ে থাকার কথা ছিল তাদের নাম। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেটা হয়নি। জীবন বাজি রেখে যে দেশকে স্বাধীন করেছেন, সেই দেশের মাটিতে মাহবুব ভাইয়ের জায়গা হয়নি। পরিবারের ইচ্ছাতে সুদূর কানাডায় সমাহিত করা হয়েছে। সেই সময়ই আমরা পার্টির পক্ষ থেকে দেশবাসীর নিকট দুঃখ প্রকাশ করেছিলাম।
এই পুঁজিবাদী সমাজ রাজনীতির মাঠে অনেককে আমরা দেখতে পাই সুবিধাবাদী ধারার সাথে যুক্ত হয়েছে। মাহবুব ভাই ছিলেন ব্যতিক্রম। কোনো সুবিধার হাওয়া বইতে শুরু হয়েছে শুনলে তিনি সেখান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতেন। মাহবুব ভাইয়ের পারিবারিক অবস্থা ছিল নিম্নবিত্ত। কিন্তু পরিবারের কথা চিন্তা করেও কোনো দিন সুবিধাবাদের সাথে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবেননি। তিনি যে মৃত্যুর পূর্ব দিন পর্যন্ত সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের পক্ষে অবিচল ছিলেন তাতে কারো কোনো সন্দেহ নেই। যে মাহবুব ভাই ইকবাল হল থেকে রওনা দিতেন একা একা, মধুর ক্যান্টিনে ঢুকতেন শত শত, হাজার হাজার নেতাকর্মী নিয়ে, লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতার মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই মাহবুব ভাই অল্প কয়েকজন নিয়েও পার্টি করেছেন সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে আপসহীনভাবে। আজ দেশে ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থান অন্তর্বর্তি সরকার শাসনে মধ্যে বামপন্থীরা পথহারা পথিক হয়ে সময় পার করছে। সেই সময় আ ফ ম মাহবুবুল হকের মতো শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের বড্ড প্রয়োজন ছিল। তিনি আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর নীতি আদর্শ দর্শনের ভিত্তিতে যদি সংগঠন সঠিক সংগ্রাম গড়ে তুলে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারে, তবেই তাকে যথাযথ সম্মান করা হবে। তিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন আমাদের মাঝে।
লেখক : বাসদ নেতা। সম্পাদক, দৈনিক বাঙলার জাগরণ