আমার কাগজ ডেস্ক
পুরুষদের সম্পর্কে কতটা জানি আমরা! নারীদের তুলনায় পুরুষেরা স্বাস্থ্যগত জায়গায় যে পিছিয়ে রয়েছে এটা কি আমরা জানি! আমরা কি জানি বিশ্বব্যাপী পুরুষদের গড় আয়ুষ্কাল নারীদের তুলনায় প্রায় ৫-৬ বছর কম? বাংলাদেশেও এই ব্যবধান তিন বছরের মতো।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ পুরুষ প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন, যার ফলে ছোটখাটো সমস্যা পরে বড় আকার ধারণ করে।
শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যেও পুরুষরা পিছিয়ে। বিশ্বব্যাপী পুরুষদের আত্মহত্যার হার নারীদের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি, এবং বাংলাদেশেও এটি ৫৪% বেশি।
এই উদ্বেগজনক চিত্রের কারণ হলো, আবেগপ্রকাশ বা মানসিক দুর্বলতা দেখানোকে সমাজে পুরুষদের জন্য ‘অসম্মানজনক’ মনে করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৬০ শতাংশ পুরুষ মানসিক চাপ বা বিষণ্ণতায় ভুগলেও কারও কাছে সাহায্য চান না। নারীদের তুলনায় পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা কম হয়, কারণ সামাজিক কাঠামো পুরুষদের ‘শক্তিশালী’ এবং ‘সংযত’ থাকার চাপ দেয়, যা তাদের একাকিত্ব ও চাপ বাড়ায়।
এই সংকটের পেছনে অন্যতম কারণ হলো টক্সিক ম্যাসকিউলিনিটি। আমাদের সমাজে পুরুষদের শারীরিক বা মানসিক সমস্যা নিয়ে কথা বলাকে দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়।
আর ঠিক এ জায়গা থেকেই প্রতি বছর ১৯ নভেম্বর, আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস পালিত হয় সমাজ, পরিবার এবং সম্প্রদায়ে পুরুষদের উল্লেখযোগ্য অবদানকে স্বীকৃতি ও সম্মান জানাতে।
এই দিনটি লিঙ্গ সমতা এবং পুরুষদের সমস্যাগুলোর প্রচারের পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, এবং পুরুষের মধ্যে ইতিবাচক রোল মডেলগুলো সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়।
১৯৯৯ সালে প্রথম ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোতে ড. জেরোম তেলুকসিং পুরুষ দিবস পালন করেন।
কেন এটি পালিত হয়?
চারপাশের পুরুষ- বাবা, ভাই, অংশীদার বা বন্ধু, যারা আমাদের জীবনে অবদান রাখেন- তাদের প্রশংসা করার সুযোগ নিয়ে আসে এই দিনটি।
উদযাপনকে উপলক্ষ করে এই দিনে পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্যের লড়াই, আত্মহত্যার উচ্চ হার এবং সামাজিক চাপের ওপরও আলোকপাত করা হয়।
আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের লক্ষ্য হলো প্রচলিত ধারণাগুলো ভেঙে দেওয়া, খোলামেলা কথোপকথনকে উত্সাহিত করা এবং পুরুষদের স্বাস্থ্যকর এবং সুখী জীবনযাপনের জন্য সহায়ক ব্যবস্থা তৈরি করা।
ইতিহাস
আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের ধারণাটি প্রথম ১৯৯২ সালে প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৯ সালে ডাঃ জেরোম তেলুকসিং উদ্যোগটিকে পুনরুজ্জীবিত না করা পর্যন্ত এটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয়নি। তিনি পুরুষদের সাফল্য উদযাপন করার জন্য একটি দিবসের কল্পনা করেছিলেন এবং পুরুষদের স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ওপরও ফোকাস করেছিলেন। বিষাক্ত পুরুষতন্ত্রের প্রভাব এবং ইতিবাচক পুরুষ বৈশিষ্ট্য লালনপালনে গুরুত্ব দেওয়া হয় পুরুষ দিবসে ।
সূচনা থেকেই, পুরুষ দিবস একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশে উদযাপন, আলোচনা এবং সচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে।
২০২৪ সালের থিম হচ্ছে, ‘পুরুষ স্বাস্থ্য চ্যাম্পিয়ন’। এটি পুরুষদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার উন্নতিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, ছেলে এবং পুরুষদের স্বাস্থ্যের চ্যালেঞ্জ কমাতে কাজ করার ব্যক্তি এবং সংস্থাগুলোকে উৎসাহিত করতেই এই থিম বেছে নেওয়া হয়েছে।
থিমটি শারীরিক, সামাজিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সুস্থতার ওপর জোর দেয় এবং সম্প্রদায়কে পুরুষদের স্বাস্থ্য উদ্যোগকে সমর্থনের জন্য উৎসাহিত করে ৷
‘পুরুষ স্বাস্থ্য চ্যাম্পিয়ন’ থিমের এর চারটি মূল ক্ষেত্রের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেগুলো হলো-
১. পদক্ষেপ নিন, সুস্থ থাকুন: স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং শেয়ার করা অভিজ্ঞতাকে উৎসাহিত করে এমন কার্যকলাপের প্রচার।
২. আপনার সঙ্গীদের নজরে রাখুন: পুরুষ যাদের সাহায্য প্রয়োজন- তাদেরকে সহায়তার জন্য আশেপাশের মানুষকে উৎসাহিত করা।
৩. সুস্থ ভবিষ্যত গড়ে তুলুন: উন্নত ভবিষ্যতের জন্য পুরুষের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা গড়ে তোলা।
৪. স্বাস্থ্য সচেতন কমিউনিটি তৈরি: যারা পুরুষদের সুস্থতার জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া।
আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস ছয়টি স্তম্ভ দ্বারা পরিচালিত হয় যা সচেতনতা তৈরি করতে এবং পুরুষদের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে ডিজাইন করা হয়েছে।
এই স্তম্ভগুলো হলো-
১. পুরুষদের অবদান উদযাপন: পুরুষদের কৃতিত্বকে সম্মান করা, বিশেষ করে পরিবারে পিতা এবং যত্নশীল পুরুষের অবদানকে উদযাপন করা।
২. লিঙ্গ সম্পর্কের উন্নতি: লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করণ এবং আরও ভাল বোঝাপড়ার প্রচার।
৩. পুরুষদের বিরুদ্ধে বৈষম্য হাইলাইট করা: সামাজিক পরিষেবা এবং সামাজিক প্রত্যাশার ক্ষেত্রে পুরুষরা যে চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মুখীন হযন সে সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
৪. একটি নিরাপদ বিশ্ব তৈরি করা: বিশ্বকে একটি নিরাপদ জায়গা করে তোলার চেষ্টা করা যেখানে প্রত্যেকে তাদের সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারে।
৫. পুরুষদের স্বাস্থ্যের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা: পুরুষদের সামাজিক, মানসিক, শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখা।
৬. ইতিবাচক পুরুষ রোল মডেলের প্রচার: সেলিব্রিটিদের পাশাপাশি আমাদের সমাজে নিত্য ইতিবাচক কাজ করে ‘রোল মডেল’ হওয়া পুরুষদের স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা।
আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস মানসিক স্বাস্থ্য, লিঙ্গ ভূমিকা, এবং সামাজিক প্রত্যাশা সম্বোধন করে কর্মশালা এবং সেমিনারসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। পুরুষদের অবদানকে সম্মান জানাতে কমিউনিটি ইভেন্ট, পাবলিক ক্যাম্পেইন এবং স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমেরও আয়োজন করা হয়।
স্বাস্থ্য উদ্যোগগুলো উদযাপনের একটি মূল অংশ, সুস্থতা প্রচারাভিযানগুলো বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারার প্রচার করে৷