খাজা মোহাম্মদ মুস্তাকিম
বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। আপনাদের নেতৃত্বে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে যা আমাদের দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং জনগণের কল্যাণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নতুন সরকারের নেতৃত্বে আমরা আশাবাদী যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আরও উন্নত ও সমৃদ্ধ হবে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের জাতীয় অগ্রগতির মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড এবং শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া একটি দেশের প্রকৃত অগ্রগতি সম্ভব নয়। দেশের উচ্চশিক্ষা গ্রামাঞ্চলের গরীব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বেসরকারি কলেজগুলোতে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছিল। কিন্তু বিগত তিন দশকে এই শিক্ষকদের বেতন-বঞ্চনার ফলে তারা শ্রমদাসের মতো জীবনযাপন করছেন।
বিগত সরকারের ভ্রান্ত জনবল কাঠামো নীতিমালা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরদর্শীতার কারণে যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই কোর্স চালু করা হয়েছিল তা বাস্তবায়িত হয়নি। এর মূল কারণ হলো, অনার্স-মাস্টার্স কোর্সে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত না করা। ফলে, অনেক অনার্স-মাস্টার্স কলেজের শিক্ষক এমপিওভুক্ত নন এবং তারা নানা রকম আর্থিক ও সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
দীর্ঘ একত্রিশ বছর ধরে এই শিক্ষকেরা বেতনহীন অবস্থায় শিক্ষাদান করে আসছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি বিধি মোতাবেক এই শিক্ষকরা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, কিন্তু বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। সরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও ৯০% কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের বেতন প্রদান করে না। শিক্ষকদের বেতন বাবদ যা দেয়া হয় তা বর্তমান বাজার দরে জীবনযাপনের জন্য অত্যন্ত অপ্রতুল। এই বেতন-বঞ্চনার ফলে শিক্ষকদের জীবনমান নিম্নমুখী হয়েছে এবং তারা মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের আর্থিক অনটনের কারণে অনেকেই পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত।
বর্তমানে দেশের বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকরা এক দুঃসহ অবস্থায় আছেন। শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি নেওয়া হলেও সেই অর্থ শিক্ষকদের মধ্যে সঠিকভাবে বণ্টন করা হয় না। জানা গেছে, শিক্ষকদের বেতনের নাম করে গরীব ছাত্রছাত্রীদের নিকট থেকে মাসে ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা করে বেতন নেওয়া হলেও শিক্ষকদের বেতন বাবদ ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে দিয়ে থাকে যা একজন শিক্ষকের বর্তমান বাজার দরে জীবনযাপন করা অসম্ভব। শুধু তাই নয়, অধিকাংশ কলেজেই মাসের পর মাস সামান্য টাকাটাও ফান্ডে অর্থ না থাকার অজুহাতে বন্ধ রাখা হয়।
শুরুতে কলেজের সংখ্যা গুটি কয়েক হলেও ২০১৯ সাল পর্যন্ত তা ৬০০ ছাড়িয়ে যায়। ২০১৮ সালে অনেক বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণ করার পর বর্তমান অনার্স-মাস্টার্স পাঠদানরত কলেজের সংখ্যা ৪০৫ টি ও শিক্ষকের সংখ্যা ৫৫০০ জন।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স কলেজের শিক্ষকরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) এর তথ্য অনুযায়ী দেশে ২০৪১টি অনার্স-মাস্টার্স কলেজ রয়েছে যার মধ্যে ১৮৮৭টি বেসরকারি কলেজ। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অধিকাংশ শিক্ষকই নন-এমপিও অবস্থায় রয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৫৫০০ নন-এমপিও শিক্ষক অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। তাঁদের কাজের পরিধি বিশাল হলেও তাঁদের পেশাগত অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের বেতন অত্যন্ত কম যা তাঁদের মৌলিক চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত নয়। প্রথম আলোর এক তথ্যমতে সরকারী শিক্ষকদের মত বেতন বৃদ্ধি পেনশন চিকিৎসা সুবিধা থেকে তাঁরা বঞ্চিত। ফলে তাঁদের আর্থিক স্থিতিশীলতা থাকে না এবং তাঁরা পরিবারকে সঠিকভাবে সহায়তা করতে পারেন না। শিক্ষক সমিতির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য মতে নন-এমপিও শিক্ষকদের চাকরির কোন নিশ্চয়তা নেই। যে কোন সময়ে তাঁদের চাকরি হারানোর আশঙ্কা থাকে যা তাঁদের মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয় এবং তাঁদের পেশাগত মনোবল কমিয়ে দেয়। তাদের পেশাগত প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের সুযোগের অভাব রয়েছে। অধিকাংশ নন-এমপিও শিক্ষক নিয়মিত প্রশিক্ষণ পান না যা তাঁদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক হতে পারত।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষক নিয়মিত বেতন-ভাতা পেনশন গ্র্যাচুইটিসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের প্রায় ৭০ শতাংশ তাদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণে গত পাঁচ বছরে প্রায় ২০% নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক পেশা পরিবর্তন করেছেন। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একটি গবেষণায় দেখা গেছে মাত্র ২৫% নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক গত পাঁচ বছরে কোনো প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। এছাড়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য সকল শিক্ষককে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ বাজেট বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে সরকার পর্যায়ক্রমে সকল যোগ্য শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করার পরিকল্পনা করছে। তবে এর জন্য একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা এখনও নির্ধারণ করা হয়নি।
জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন। বাংলাদেশ শিক্ষক ফেডারেশনের দাবি অনুযায়ী জিডিপির কমপক্ষে ৬% শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা প্রয়োজন যার একটি বড় অংশ নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তিতে ব্যয় করা উচিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫% যুব জনগোষ্ঠী। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে গুণগত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা একটি যুগোপযোগী পদক্ষেপ হবে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ৪ নং লক্ষ্যে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা এই লক্ষ্য অর্জনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধি ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এই নীতির আলোকে নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা উচিত।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা, সরকারি বিধি ও শিক্ষানীতির আলোকে অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা উচিত। এক্ষেত্রে কিছু যৌক্তিক দিক রয়েছে। প্রথমতঃ সরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক এনটিআরসি সনদধারী শিক্ষকেরা বেসরকারি এমপিওভুক্ত কলেজের অনার্স মাস্টার্স কোর্সে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। তাই এই সকল শিক্ষকরা এমপিও পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। দ্বিতীয়তঃ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর উচ্চশিক্ষা কৌশলে সরকারি/বেসরকারি কলেজে ৩ বছরের ডিগ্রী (পাশ) কোর্স পরিবর্তে ৪ বছরের অনার্স কোর্স চালু করার কথা উল্লেখ রয়েছে এবং তা শিক্ষা সমাপনী যোগ্যতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী সময়ে দেশে শত শত কলেজে অনার্স কোর্স চালু করা হয় এবং শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। তাই মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন ও জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকর করার জন্য হলেও বেসরকারি অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকরা এমপিও পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা ২৫ টাকা টিউশন ফি দিয়ে লেখাপড়া করছে অথচ গ্রামের গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীরা ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা টিউশন ফি দিয়ে পড়তে হচ্ছে। তাই গ্রামের গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বেসরকারি অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিও দেওয়া প্রয়োজন।
শিক্ষার প্রধান নিয়ামক শক্তি হলো শিক্ষক। শিক্ষকদের বেতন বঞ্চিত রেখে কখনোই মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আমরা আশাবাদী যে, নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে এই শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিগুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হবে। মাননীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের এই ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বিপ্লবী পরিবর্তন আনবেন।
নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আমাদের এই অভিনন্দন পত্রের মাধ্যমে আমরা আমাদের দাবি তুলে ধরছি এবং আশা করছি যে, আপনারা আমাদের এই দাবিগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করবেন। এটি শুধুমাত্র শিক্ষকদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নয়, বরং সামগ্রিকভাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকদের মানোন্নয়ন করা গেলে শিক্ষার মানও উন্নত হবে, যা দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। তাই, আমরা অনুরোধ জানাই যে, আপনারা আমাদের এই ন্যায্য দাবিগুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, হাবীবুল্লাহ্ বাহার কলেজ, ঢাকা।