আমার কাগজ ডেস্ক
লুটপাটের কারণে সংকটে পড়েছে বেসরকারি খাতের প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এ সময়ে উচ্চ শিক্ষালয়টির এফডিআর ভেঙে ও আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে এ অর্থ লোপাট করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৫ কোটি টাকা সরানো হয়েছে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে থাকা এফডিআর ভেঙে। বেসরকারি এ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রিজার্ভ ফান্ড এবং নিয়মিত ফান্ড থেকে এসব অর্থ সরিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বপ্রাপ্তরা। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টির আর্থিক বিবরণী, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদন এবং সংশ্লিষ্ট হিসাব বিশ্লেষণে এসব অনিয়মের তথ্য মিলেছে।
আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল রক্ষায় কাজ করার কথা থাকলেও উলটো সেই তহবিল লুটপাটে ভূমিকা রেখেছেন বেসরকারি প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার ড. ইফফাত জাহান। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য, অর্থ বিভাগের পরিচালকসহ একদল কর্মকর্তা এ লুটপাট চক্রের সদস্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাসের ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে গাড়ি ক্রয়, মেইনটেন্যান্স ও জ্বালানি ক্রয়; সিকিউরিটি গার্ড ও ক্লিনিং সার্ভিস, ক্যাফেটেরিয়া ভাড়া, বিভিন্ন অফিসের সাজসজ্জা, আসবাবপত্র ক্রয়, বিভিন্ন গবেষণাগারের সামগ্রী ক্রয়, সরকারের ট্যাক্স ও ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে নানা জালিয়াতির মাধ্যমে এসব অর্থ হাতিয়েছে সিন্ডিকেটটি। বিপুল ঋণের চাপে বিঘ্নিত হচ্ছে স্বাভাবিক কার্যক্রম। অর্থ সংকটের কারণে শিক্ষক, কর্মচারীরা একদিকে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন, অন্যদিকে শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন শিক্ষার্থীরাও।
উল্লেখ্য, রাজধানীর বনানীর এইচবিআর টাওয়ার ও কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর স্টার টাওয়ারে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়টির পাঠদান চলছে।
নিয়ম অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নকাজে খরচের পরিমাণ ৫ লাখ টাকার বেশি হলে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করতে হয়। সেক্ষেত্রে অর্থ কমিটি, ক্রয় কমিটি ও ট্রাস্টি বোর্ডের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু ২০২৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে ৮ কোটি ৭২ লাখ টাকার কাজে দরপত্র আহ্বান না করেই চুক্তি করা হয়। ইফফাত জাহান ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্বে থাকাকালীন ক্রয় কমিটি কিংবা বিওটির অনুমোদন ছাড়াই এই চুক্তি করেন। চুক্তির পর পরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ১৫ মার্চের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়কে কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী আমানত বা ফিক্সড ডিপোজিট (এফডিআর) ভেঙে প্রায় ৪ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। আবার ক্যাম্পাস নির্মাণের অল্প কিছু কাজ করেই ঠিকাদার পালিয়ে গেছেন। তার পরও কাজ শুরু হয়নি, চুক্তিও বাতিল হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, এসব অনিয়মের প্রায় সব কটিতেই জড়িত ছিলেন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রায়হান আজাদ টিটু। এর আগে নানা অনিয়মের অভিযোগে তাকে সেখান থেকে অপসারণও করা হয়েছিল। জড়িতদের মধ্যে আরো ছিলেন সাবেক ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ড. শুভময় দত্ত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব শাখার পরিচালক (সাময়িক বরখাস্তকৃত) শিপার আহমেদ। শিপার আহমেদের বিরুদ্ধে ভর্তি অফিস থেকে প্রায় ৮০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এসব অনিয়মে তাদের সহায়তা করেছেন ভর্তি ও বিপণন শাখার সাময়িক বরখাস্তকৃত সহকারী পরিচালক তানভীর আহমেদ, ক্রয় বিভাগ থেকে পদত্যাগ করা সহকারী পরিচালক নাহিদ হাসান ও সহকারী পরিচালক জুবায়ের সিদ্দিক তানিন। কোষাধ্যক্ষ হিসেবে আর্থিক অনিয়মের পেছনে ইফফাত জাহানের হাত রয়েছে। ইফফাত জাহান ও টিটুসহ অন্যদের বিভিন্ন অনিয়ম সামনে আনায় শিক্ষার্থীদের দিয়ে আন্দোলন করিয়ে উপাচার্য ড. শুভময় দত্তকে পদত্যাগ করানো হয়েছে।
জানা যায়, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ সামনের আসার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজকে অপসারণে তত্পর হয়ে ওঠেন ইফফাত ও টিটুসহ তাদের সহযোগীরা। এর অংশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামানোর কৌশল নেন তারা। এ জন্য এক গোপন বৈঠকে ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টরা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক কয়েক জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ ও বিওটি অপসারণের দাবি চূড়ান্ত হয়। এর অংশ হিসেবে ইউজিসি ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেন তারা। তবে শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেও দাবি আদায় করতে না পেরে ভিন্ন পথে হাঁটেন তারা। উপাচার্যের পিএস নাঈমুল ইসলামের নামে গত ৬ জানুয়ারি বেলা সাড়ে ৩টায় একটি জরুরি সভা আহ্বান করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত ভিসি ও ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার, সব অনুষদের ডিন, সব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, প্রক্টর ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সভা থেকে বিওটি অপসারণ ও স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের দাবির বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। এরপর ৭ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৯টায় ‘লং মার্চ টু শিক্ষা মন্ত্রণালয়’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। মূলত কোষাধ্যক্ষ সবাইকে চাপ দিয়ে সচিবালয়ের কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করেন।