
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি
মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার সাইংজুরি গ্রামের চেনু খানের ছেলে হারেজ খান তখন স্কুলছাত্র। সেই সময় পরিচয় হয় এক সাধু বাবার সঙ্গে। পেয়ে বসে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের নেশা। ছিল গানের নেশাও। বাড়ির পাশেই একটি কুঁড়েঘরে বসে গান করতেন তিনি। মানুষকে দিতেন পানিপড়া। এক সময় কাউকে কিছু না জানিয়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে হারিয়ে যান তিনি। ১৯৯০ সালে কিশোর হারেজ খানকে খুঁজে পায়নি তার পরিবার।
সারাদেশ ঘুরে একপর্যায়ে তিনি চলে আসেন চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার হোগলডাঙ্গা গ্রামে। একটি গাছের নিচে বসে থাকতে দেখে তাকে বাড়ি নিয়ে যান হোগলডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা সোনাহার মণ্ডল। সেই থেকে নিজের পাঁচ ছেলে-মেয়ের মতো করেই লালন পালন করেন তাকে। তখন কিছুটা মানুষিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন হারেজ। তবে, তাকে বাবা-মায়ের অভাব বুঝতে দেননি সোনাহার দম্পতি। সেখানে অনেক আদর যত্নে জীবন কাটতে শুরু করে তার। একই সঙ্গে তার সঙ্গে খুব সখ্যতা তৈরি হয় গ্রামের মানুষের।
সম্প্রতি সঠিক ঠিকানা বলতে পারায় হারেজের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন সোনাহার মণ্ডলের ছেলে মতিয়ার রহমান। পরে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে হোগলডাঙ্গা গ্রামে আসেন হারেজের পরিবার। দীর্ঘদিন পর ভাইকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন একমাত্র বোন নূর জাহান। তৈরি হয় এক হৃদয় বিদারক পরিবেশ। অশ্রুসিক্ত হয় গ্রামের মানুষের চোখ। যেন কোনো এক আপনজনকে বিদায় দিচ্ছেন তারা। বিদায় অশ্রুসিক্ত হলেও দীর্ঘ ৩৩ বছর পর হারেজ আপন ঠিকানায় ফিরে যাওয়ায় খুশি সবাই।
হোগলডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা সেলিম মিয়া জানান, খুব ছোট থেকে আমি হারেজ খানকে দেখছি। তিনি আসার পর গ্রামের সব মানুষ তাকে ভালবাসেন। তিনি তখন গান গাইতেন। গানের মাধ্যমে তিনি তার এলাকার নাম, পরিবারের সদস্যদের নাম বলতেন। তখন আমরা বুঝতাম না। সম্প্রতি তিনি তার বাবা মায়ের নাম ও ঠিকানা বললে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা তাকে নিয়ে গেছেন।
সোনাহার মণ্ডলের ছেলে মতিয়ার রহমান জানান, দীর্ঘদিন থেকে আমার বাবা হারেজ ভাইকে লালন পালন করেছেন। সম্প্রতি সঠিক ঠিকানা বলতে পারায় আমি তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। মোবাইল ফোনে ছবি ও ভিডিও কলে কথা বলে তারা হারেজকে শনাক্ত করেন। শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) তারা মানিকগঞ্জ থেকে আমাদের বাড়ি আসেন। পরে হারেজ ভাইকে নিয়ে যান।
৩৩ বছর পর আপন ঠিকানায় ফিরলেন হারেজ, কাঁদলেন গ্রামবাসী
নিজের অন্য সন্তানদের মতো হারেজকে মানুষ করেছেন বলে জানান সোনাহার মণ্ডল। তিনি বলেন, ১৯৯০ সালে তাকে আমাদের গ্রামের বটতলায় পাই। তারপর তাকে বাড়ি নিয়ে আসি। তখন সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল। আমাদের আদর যত্নে সে ভালো হয়ে উঠেছে। আমার পাঁচ ছেলে-মেয়ের মতো করেই তাকে আমি মানুষ করেছি। কখনও তাকে বাবা-মায়ের অভাব বুঝতে দিইনি। এখন তাকে বিদায় দিতে গিয়ে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার আপন ছেলে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
হারেজ খানের বোন নূর জাহান খাতুন জানান, আমাদের বাবা মারা গেছেন। মা বেঁচে আছেন। ভাই হারিয়ে যাওয়ার পর তাকে অনেক খুঁজেও পায়নি। ৩৩ বছর পর একমাত্র ভাইকে খুঁজে পেয়ে অনেক আনন্দ লাগছে। তার সঙ্গে আবার দেখা হবে ভাবতেও পারিনি।
মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কাজী মাহেলা বলেন, এখনকার যুগে কেউ কাউকে দেখে না। কিন্তু সোনাহার মণ্ডল তার নিজের ছেলের মতো করেই হারেজকে লালন পালন করেছেন। সোনাহার মণ্ডলের এমন মানবিক কাজ একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।