কক্সবাজারের টেকনাফ মেরিন ড্রাইভে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। দেড় বছর পর আজ কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল রায় ঘোষণা করবেন। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে রায় পড়া।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে সিনহাকে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পরপরই পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ এবং তৎকালীন সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
২০২০ সালের ৫ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের সংগঠন ‘রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন-রাওয়া’ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে সিনহা হত্যা মামলার বিচার দাবি করে তা দ্রুত নিস্পত্তির আহ্বান জানায়।
হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পর ওই বছরের ৫ আগস্ট আদালতে হত্যা মামলা করেন সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার। আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় এলিট ফোর্স র্যাব। চার মাস দশ দিন পর একইবছরের ১২ ডিসেম্বর কক্সবাজার আদালতে ২৬ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র জমা দেয় র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা।
সিনহা নিহতের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে অতিরিক্ত ডিআইজি এবং লে. কর্নেল মর্যাদার একজন সেনা কর্মকর্তাকে সদস্য করে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, সিনহা তার সঙ্গী সিফাতকে সঙ্গে নিয়ে মারিশবুনিয়ার টুইন্যার পাহাড়ে ‘টাইম ল্যাপস’ ভিডিও করতে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যার পর পাহাড়ে আলো দেখে স্থানীয় কয়েকজন তাদের ডাকাত বলে সন্দেহ করেন।
তদন্ত কমিটির কাছে পরিদর্শক লিয়াকত আলী বলেছেন, মারিশবুনিয়া গ্রামের কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সেক্রেটারি নুরুল আমিন তাকে ফোন করে বলেছিলেন যে পাহাড়ে ডাকাতরা ছোট ছোট আলো ফেলে ঘোরাঘুরি করছে। লিয়াকত তখন মাদক উদ্ধার অভিযান থেকে ফিরছিলেন। নুরুল আমিন আবার ফোন করে বলেন, সেনাবাহিনীর পোশাক পরা সেই লোকেরা গ্রামবাসীকে গুলি করেছেন। তারা সিলভার রঙের গাড়িতে করে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছেন। নুরুল আমিনও কমিটির কাছে একই কথা বলেছেন। কমিটি বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের ৩৫ জন পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, যারা কেউই এ কথা জানতেন না। কথা হয়েছে শুধু লিয়াকত ও নুরুল আমিনের মধ্যে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, লিয়াকত সে খবর কাউকে জানাননি। এমনকি ওসি বা ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাকেও না। তিনি খবর যাচাই করার জন্য ইউপি সদস্য, চেয়ারম্যান বা স্থানীয় কাউকে ফোন করেননি। কোনো সহকর্মীকেও সেটা বলেননি। লিয়াকত কমিটিকে বলেছেন, খবর যাচাই করার সময় তিনি পাননি। মারিশবুনিয়ার মসজিদ থেকে যখন ‘ডাকাত’ বলে মাইকিং করা হচ্ছিল, তখন নিষেধ করেছিলেন ইমাম জহির আলম। তিনি বলেছিলেন, তারা সেনাবাহিনীর লোক। পাহাড়ে যাওয়ার সময় তার সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছিল।
পাহাড় থেকে নেমে শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে আসার আগে সিনহা বিজিবির একটি চৌকিতে থেমেছিলেন। বিজিবির সদস্যরা সিনহার পরিচয় জানার পর তাকে স্যালুট করেছিলেন। সেখান থেকে ছয় কিলোমিটার আসার পর শামলাপুর তল্লাশিচৌকি, যেখানে সিনহাকে গুলি করা হয়। এর এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে সেনাবাহিনীর তল্লাশিচৌকি।
এপিবিএনের সদস্যরা কমিটিকে বলেছেন, লিয়াকত চৌকিতে এসে কিছু বলেননি। তিনি শুধু তল্লাশিচৌকির এসআই শাজাহানকে ফোন করেছিলেন। তাছাড়া তিনি যখন ফোনে ডাকাতের খবর পেয়েছিলেন, তখনো তার সঙ্গে পুলিশের একটি দল ছিল। কিন্তু তিনি কাউকে না জানিয়ে একাই অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন।
সিনহা হত্যায় অভিযুক্ত করা হয় টেকনাফ থানা পুলিশের নয় সদস্যকে। এছাড়াও এপিবিএনের তিনজন এবং পুলিশের সোর্স তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়। তারা হলেন- বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ি এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল ছাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসাইন আজাদ, কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মামুন, কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও কনস্টেবল সাগর দেব। আর এপিবিএনের তিনজন হলেন- এসআই মো. শাহজাহান আলী, কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, কনস্টেবল রাজিব হোসেন। এছাড়া পুলিশের মামলার সাক্ষী ও পুলিশের সোর্স টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আইয়াজ আয়াছ ও মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিনকে অভিযুক্ত করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সিনহার গাড়ি তল্লাশিচৌকিতে এলে কনস্টেবল রাজিব হোসেন সংকেত দেন। গাড়ি থেমে যায়। বাঁ দিকের কাঁচ নামিয়ে সিনহা পরিচয় দিলে এসআই শাহজাহান আলী পেছনে সরে যান। গাড়ি আবার চলতে শুরু করে। এরপর লিয়াকত এসে ব্যারিকেড দিয়ে পিস্তল তাক করেন। সিনহাকে গাড়ি থেকে নামতে বলেন।
গুলিবর্ষণকারী লিয়াকত কমিটিকে বলেছেন, ‘সিনহা গাড়ি থেকে নেমে উত্তেজিত হয়ে আমার দিকে গুলি করেন।’ তবে কমিটির জেরায় লিয়াকত বলেছেন, গাড়ি থেকে নামার সময় সিনহা ডান হাত কোমরে রাখেন, এরপর পিস্তল তাক করে গুলি করেন।
কমিটি প্রতিবেদনে বলেছে, সবাই বলেছেন, সিনহার বাঁ হাত ওপরে ছিল। কিন্তু ডান হাত কোথায় ছিল, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। একেকজন একেক কথা বলেছেন।
তদন্ত কমিটির কাছে লিয়াকত বলেছেন, তিনি জানমালের নিরাপত্তার জন্য গুলি করেছিলেন। কিন্তু এসআই শাহজাহান আলী বলেন, ওই সময় লিয়াকতের স্থলে তিনি হলে গুলি করতেন না। গুলি করার কারণ হিসেবে তিনি লিয়াকতের অনভিজ্ঞতা ও সোর্সের ওপর অতিনির্ভরশীলতাকে দায়ী করেছেন।
কনস্টেবল রাজিব বলেছেন, লিয়াকত গুলি না করলে সিনহা গুলি করতেন কি না, তা তিনি বুঝতে পারেননি। আবার নন্দদুলালের কাছে কমিটি জানতে চেয়েছিল, ওই সময় লিয়াকতের জীবনের কোনো শঙ্কা ছিল কি না? জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমি এ রকম চিন্তা করিনি। ’
অন্য সব সাক্ষী কমিটির কাছে যেসব কথা বলেছেন, তাতে কমিটি মনে করে, সিনহাকে মেরে ফেলার জন্য গুলি করা হয়েছে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক কমিটিকে বলেছেন, একটি গুলি দূর থেকে করা হলেও পরের সব গুলি খুব কাছ থেকে করা হয়েছিল।
সিনহাকে গুলি করার ২০ থেকে ২৫ মিনিট পর প্রদীপ ঘটনাস্থলে আসেন। এর আগে সিনহাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রদীপ আসার ২২ মিনিট পর সিনহাকে ট্রাকে তোলা হয়। কমিটি বলেছে, হাসপাতালে যেতে অস্বাভাবিক দেরি হওয়ায় বিনা চিকিৎসায় সিনহা মারা যান।