রাবি প্রতিনিধি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কাজলা গেট থেকে শের-ই-বাংলা হল পর্যন্ত আধা কিলোমিটার বিস্তৃত রাস্তাটি ‘প্যারিস রোড’ নামে খ্যাত। সম্ভবত ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের রাস্তাগুলোর সাথে মহা-প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েই এই গৌরবময় খেতাব ছিনিয়ে নিয়েছিল রাস্তাটি। রাস্তার দু’পাশে আকাশচুম্বী ছায়াবতী শীরিষ গাছগুলো ‘স’ করে চুল ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে আজও। এ যেন রাস্তার অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় জেগে আছে যুগের পর যুগ ধরে।
তবে আগের মতো কি তরতাজা যৌবন আছে সৌন্দর্যের প্রতিমা স্বরূপ এ রোডটি? প্যারিস রোডের দিকে এক পলক তাকিয়েই যেকেউ উত্তর দিবে ‘না’। একসময়কার সৌন্দর্যের প্রতীক এ রোডটি তার যৌবন হারিয়েছে বেশ কিছু বছর আগেই।
প্যারিস রোডের সৌন্দর্য আজ স্মৃতির পাতায় জায়গা করে নিতে চলেছে। নামে-গন্ধে যে রূপ-মাধুর্য নিয়ে রাবির বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল প্যারিস রোড তা আজ তলানিতে। যা আছে তাও থাকবে না ৩-৪ বছর পর। কারণ রোডটির মূল সৌন্দর্য গগণশীরিষ গাছগুলো বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে। সাধারণত ৫০-৬০ বছর বেঁচে থাকে গগণ শীরিষ নামের এই কড়াইয়ের জাতটি। তারপর শুরু হয় বার্ধক্যজনিত নানাবিধ সমস্যা।
যেমন শারীরিক দুর্বলতা, বিভিন্ন রোগে বাসা বাঁধা, পোকার আক্রমণ ইত্যাদি।
২০১৪ সালে গাছগুলোর পতন শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত সিংহভাগ গ্রাস করেছে ঝড়ের প্রকোপ, রাস্তার মেরামত কাজ এবং রোগের আক্রমণ। একটু ঝড়-বৃষ্টি হলেই আবেগের অপর নাম প্যারিস রোড হয়ে উঠছে আতঙ্কের আতুরঘর। ভেঙে পড়ছে ছোট মাঝারি থেকে শুরু করে বড় বড় ডালগুলো। এমনকি ২০১৯ সালে একটি গাছ উপড়ে পড়েছিল ভিসির বাস ভবনের সামনে। চরম আতঙ্ক আর ভারাক্রান্ত মন নিয়ে হতাশার কথা জানাচ্ছে প্রকৃতি প্রেমিক মানুষরা।
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক বিষ্ণু কুমার অধুকারী বলেন, “প্যারিস রোড ইতিহাস, ঐতিহ্যে এবং নান্দনিক সৌন্দর্যের আঁধার। এটা আমাদের আবেগ ও ভালোবাসার জায়গা। সাম্প্রতিক সময়ে গাছগুলোর বয়সসীমা শেষ হওয়ার কারণে বিভিন্ন পোকা-মাকড় বাসা বেঁধেছে, রোগাক্রান্ত হচ্ছে এবং ভঙ্গুর হয়ে দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ফলে ঝড়ের কবলে পড়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে গাছগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের বনপরিবেশ ও সৌন্দর্য বর্ধন কমিটি প্যারিস রোডের বিষয়টি নিয়ে দ্রুত আলোচনা করে কার্যকরী পদক্ষেপ নেবে বলে আমরা আশা করছি।”
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী সালাহউদ্দিন আম্মার বলেন, “রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখে আর প্যারিস রোডের সৌন্দর্যে মুখরিত হয় না এমন কোনো ছাত্র-ছাত্রী আছে বলে আমার মনে হয় না। অসামান্য সৌন্দর্যে মোড়ানো এই প্যারিস রোড। সাক্ষী আছে হাজারো প্রেমের, সাক্ষী আছে হাজারো বিচ্ছেদের। সাক্ষী আছে হাজারো স্বপ্নের আবার সাক্ষী আছে হাজারো দুঃস্বপ্নের। রাস্তার দু’পাশ দিয়ে সারি সারি গাছ যেন দাঁড়িয়ে আছে প্রেয়সীর রাগ ভাঙ্গানোর দায়িত্ব নিয়ে। আপনি পারবেন না এখানে এসে মন খারাপ করে থাকতে। বৃষ্টি ভেজা প্যারিস রোড যেন প্রকৃতিতে বানানো জান্নাত। বৃষ্টির ফোটায় ফোটায় জীবনের কষ্টগুলো যেন ধুয়ে মুছে দেয়।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের স্বপ্নের প্যারিস রোডের চারপাশের গাছগুলো ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। শতবছরের প্রেম, বিরহ, বন্ধুত্বের সাক্ষী গাছগুলো ভেঙ্গে পড়ছে হালকা বাতাসেই। আমি এ সৌন্দর্যের ভাগিদার হিসেবে প্রশাসনকে এই সৌন্দর্য বাঁচিয়ে রাখার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
প্যারিস রোড সম্পর্কে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে আইন বিভাগের ইহতেসাম বিল্লাহ বলেন, “এক অদ্ভুত আলো-ছায়া মাখা নির্মল সৌন্দর্যের রূপ ধারণ করে জেগে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোড। রাস্তার প্রহরী শীরিষ গাছগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। হাজারো শিক্ষার্থীর আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা ও উৎকণ্ঠার সাক্ষী হয়ে আছে এই অনিন্দ্য সুন্দর রোডটি। কিন্তু অত্যন্ত হতাশার সাথে বলতে হচ্ছে যে, আমাদের এ আবেগের ইতি টানতে চলেছে বয়সের ভার। দিন দিন সৌন্দর্য বিলুপ্তির পথে যাচ্ছে আমাদের এ ঐতিহ্যের। ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য রক্ষার কথা বললেও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে আমরা দেখছি না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। আমরা আশা করছি এদিকে প্রশাসন সুনজর দিলে পুরানো ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব।
অপর দিকে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছেন, গগণ শীরিষের চারা উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা। ইতোমধ্যে, কিছু চারা রোপন করা হয়েছে। রাস্তা মেরামত কাজ শেষ হলে বর্ষার মৌসুমে আরো চারাগাছ লাগানো হবে।
তবে রাবি’র প্যারিস রোড এবং এর আশেপাশের সৌন্দর্য পুনরুত্থানে কাজ শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এটি নিয়ে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট থেকে পাসকৃত বৃক্ষরোপণ ও সৌন্দর্যবর্ধন কমিটি। নয় সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটিতে সভাপতি হিসেবে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার এবং সদস্য-সচিব হিসেবে আছেন পরিবেশ বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজ।
প্যারিস রোডের সৌন্দর্যবর্ধন প্রসঙ্গে ড. সাবরিনা বলেন, “আমাদের প্যারিস রোডের যেই গাছগুলো আছে, সেগুলোর চারা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। শুধু প্যারিস রোড নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রাস্তার পাশের গাছগুলো দেখভাল করেন পাঁচজন মালি। সীমিত পরিসরে, অল্প কিছু চারা হয়তো তারা তৈরি করেছেন।সম্প্রতি, বড় গাছগুলোর পাশে কিছু ছোট গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, রাস্তাটির উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে কিছু বিচ্যুতি যেগুলো হয়েছে, সেগুলো শেষ হয়ে গেলে গাছগুলো আবার জেগে উঠবে। সামনের বর্ষায় আমরা আরও কিছু চারা রোপণ করতে চাচ্ছি; সেক্ষেত্রে একই চারা অর্থাৎ প্যারিস রোডের Albizia-কেই আমরা সংরক্ষণ করব।”